আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সক্রিয় ও দলের অবস্থান সুদৃঢ় করতে কৌশলী হয়ে নতুন বছরের শুরুতেই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করতে চায় বিএনপি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। সেই সঙ্গে দলের যে সকল নেতাকর্মী আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিল তারা এখন বিভিন্ন মামলার আসামী। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে। আবার অনেকে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকেও একাধিক মামলায় ঘন ঘন আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
এছাড়া দলের আরও অনেক নেতাকর্মী মামলার ভারে ন্যুজ। এসব বিএনপি নেতাকর্মীরা এখন দলীয় কর্মকা- থেকে দূরে। তবে গতবছর জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা কিছুটা গতিশীল হলেও দলীয় তেমন কর্মসূচি না থাকায় রাজনৈতিকভাবে শক্তি অর্জন করতে পারছে না তারা। তাই প্রথমে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করতে করতে একপর্যায়ে সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদারের চেষ্টা চালাবে। আর এ আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যেই ভেতরে ভেতরে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
সূত্র মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কোন সম্ভাবনা না দেখে বিএনপি এখন আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথেই যেতে চাচ্ছে। আর হঠাৎ করে আন্দোলন শুরু করলে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হতে পারে মনে করে প্রথমেই জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে চায় বিএনপি। তবে কিভাবে আন্দোলন শুরু করে আস্তে আস্তে তা আরও গতিশীল করতে হবে এজন্য একটি কৌশলও ঠিক করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডনে অবস্থানকালেই ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন শুরু করে একপর্যায়ে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করবেন তিনি। এভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের জন্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করা হবে। তবে তাদের এবারের আন্দোলন যাতে ২০১৫ সালের লাগাতার আন্দোলনের মতো সহিংস না হয় সেদিকে সজাগ থাকতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির ওপর চাপ রয়েছে। তাই বিএনপি চাচ্ছে প্রথমেই যাতে আন্দোলন সহিংস না হয়। তবে দাবি আদায় না হলে শেষের দিকে আন্দোলন কঠোর হতে পারে বলে বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
বিএনপি হাইকমান্ড মনে করছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে চাপে ফেলা না গেলে দল ভোটের ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। আর এজন্যই তারা আসছে ইংরেজি নববর্ষ থেকেই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন শুরু করতে চায়। সুযোগ পেলে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৪ বছর পূর্তির দিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি থেকেই আন্দোলন শুরু করতে চায় দলটি।
এদিকে সময়োপযোগী কোন ইস্যু ছাড়া আন্দোলন করে সফল হওয়া যাবে না মনে করে ২০ দলীয় জোটের শরিকরাও এতদিন সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে কোন সায় না দিলেও এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে বলে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন বছরের শুরুতেই আন্দোলন শুরুর কৌশল নেয়া হয়েছে। আর তা করা হলে এ আন্দোলন করতে বিএনপির পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটের অন্য শরিক দলের নেতাকর্মীরাও উৎসাহিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা যায়, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের কথা শুনে দলের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা কমিটির পক্ষ থেকে বিএনপি হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে তারা এবার ঢাকার নেতাদের আন্দোলনের প্রকৃতি দেখে নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলনে শরিক হতে চায়। কারণ, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রের নির্দেশে কঠোর আন্দোলনে নেমে তারা যে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছিল তাতে বেশ ক’টি এলাকা রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেও ঢাকায় আন্দোলনের তেমন ছাপ ছিল না। যে কারণে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তাই এবার কেন্দ্র থেকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কেন্দ্রের আন্দোলনের অবস্থা দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলনে সক্রিয় হবে।
দলের ভেতর নানামুখী সমস্যা থাকায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। এর পর রাজনৈতিকভাবে আরও বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে সরকারবিরোধী আন্দোলনও করতে পারছিল না দলটি। তবে ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর দলের ৫ম জাতীয় কাউন্সিল করার পর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৩৮৬ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করে দলকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা শুরু করে বিএনপি হাইকমান্ড। এক পর্যায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার নির্দেশে দলের মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন নতুন কমিটির নেতাদের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
২০১২ সালে ২০ দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি জোটগতভাবে আন্দোলন চাঙ্গা করার চেষ্টা করে। আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে এক পর্যায়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে গিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন জোরদার করে। একের পর এক হরতাল, রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধসহ আন্দোলনের কঠোর কর্মসূচি পালন করলেও শেষ পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারেনি বিএনপি। কারণ, সে আন্দোলন সহিংস হওয়ায় সাধারণ মানুষের সমর্থন পায়নি। যে কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েও সফল হতে পারেনি বিএনপি জোট। আওয়ামী লীগ তাদের মহাজোটের শরিক দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করে আবারও সরকার গঠন করে। শুধু তাই নয় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটকে মাঠের বাইরে নিষ্ক্রিয় রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দাপটের সঙ্গেই সরকার পরিচালনা করে। আর বিএনপি বারবার আন্দোলনের হুমকি দিয়েও রাজপথে নামতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সিলেটে দলীয় এক অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, যে কোন সময় আন্দোলনের নির্দেশ আসতে পারে, সবাই প্রস্তুত থাকবেন। এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা সবাইকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন বছরের শুরু থেকেই আমরা জনস্বার্থে আন্দোলন শুরু করতে চাই। সরকার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে করার ব্যবস্থা না করলে আন্দোলন আস্তে আস্তে জোরদার করা হবে। আর গণতন্ত্রের স্বার্থে দেশের মানুষ এ আন্দোলনের পক্ষে থাকবে। ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন আর করতে দেয়া হবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার আদায় করা হবে। ইতিমধ্যেই আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু করা হয়েছে। জনকণ্ঠ
Leave a Reply