সমঝোতা হলে খালেদার মুক্তিতে রাজি সরকার!

বহু প্রত্যাশিত ও বহুল আলোচিত সংলাপের মধ্যে দেশের সচেতন নাগরিকসমাজ আশার আলো দেখলেও সরকার ও বিরোধী পক্ষের সম্পর্কে এ মুহূর্তে ‘জট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলত খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ইস্যু। এ বিষয়টি যে উভয় পক্ষের কাছেই এখন দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার, তা দুই পক্ষের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে জট থেকে বেরিয়ে আলোতে আসার একটি ফর্মুলার কথা সরকারপক্ষ ভেবে রেখেছে বলে জানা গেছে। আর সেটি হলো দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে—বিএনপি এই নিশ্চয়তা দিলে সরকার খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীনরা।

বিএনপি চাইলে দ্বিতীয় দফা সংলাপে বিষয়টি পরিষ্কার করবে সরকার। এ ব্যাপারে দুটি পথ বাতলে দেবে সরকার। একটি হলো বিদ্যমান ব্যবস্থায় খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে এভাবে—তিনি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামিনের আবেদন করলে সরকারপক্ষ তাঁর বিরোধিতা করবে না। আর দ্বিতীয়টি হলো প্যারলে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দ্বিমত নেই। নির্বাচনের আগেই সম্পূর্ণ আইনানুগ প্রক্রিয়ায় এই মুক্তি সম্পন্ন করা যেতে পারে। এই প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে বিএনপি রাজনৈতিক সমঝোতায় এলে তাদের স্বাগত জানাবে সরকার। বিনিময়ে বিএনপির কাছ থেকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা চাইবে সরকার। আওয়ামী লীগ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন নিজেও বলেছেন এবং কামাল হোসেনের সঙ্গে তাঁরাও কথা বলে জেনেছেন, সংলাপের ব্যাপারে তিনি সন্তুষ্ট। সংলাপে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য একটি স্থায়ী সাংবিধানিক ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ প্রস্তাবে ড. কামাল হোসেনসহ তাঁর সমমনাদের সায় দিতে দেখা গেছে। বিএনপির মধ্যে সবাই না হলেও কেউ কেউ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাঁরা আর সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে চান না।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সরকারের দ্বিতীয় দফা সংলাপে রাজি। সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাও হয়েছে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের। বিএনপির একটি পক্ষ চায় দ্বিতীয় দফায় সংলাপ হোক। তাদের মূল দাবি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টির সুরাহা হলে অন্যান্য বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব বলে তারা মনে করে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সরকারের হাইকমান্ড বিএনপির কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেলে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবির অন্যগুলোর আংশিক কিছু বিষয়েও ইতিবাচক সাড়া দেবে বলে জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সংলাপে এসেছিল। আমরা বলেছি, এটা আদালতের বিষয়। আদালত চাইলে মুক্তি দিতে পারে। আমরা বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করি না।’ তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পুনরায় সংলাপে বসতে ইচ্ছুক। আবার সংলাপ হলে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা হতেই পারে।

রাজনৈতিক সমঝোতা হলে খালেদা জিয়ার কারামুক্তি সম্ভব কি না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আপিল বিভাগে খালেদা জিয়াকে জামিন চাইতে হবে। তিনি বলেন, ইতিহাসে নজির আছে, যে দলের প্রধান কারারুদ্ধ ছিলেন সেই দল ভোটের ময়দানে সুবিধা পেয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, যদি রাজনৈতিক সমঝোতা হয়, তাহলে জুডিশিয়ারিকে এই রাজনৈতিক সমঝোতার অন্তরায় হতে কখনো দেখিনি। অবশ্যই খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেতে পারেন। তিনি জানান, চিকিৎসার জন্য প্যারলে মুক্তির ব্যবস্থাও রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বে উন্নয়নের রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছেন তিনি। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তিনি ‘মানবতার মা’ বা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন গোটা বিশ্বে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার। তবে এত কিছুর পরেও দেশে বিরোধীদের দমন এবং বিএনপিবিহীন নির্বাচন নিয়ে কিছু সমালোচনা আগে থেকেই রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। এর মধ্যে আবার নতুন করে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে—যে দেশের প্রধানমন্ত্রী এত ভালো কাজ করছেন, সেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা কেন? ঠিক যেমন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন মিয়ানমারে অং সান সু চি, যিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন, অথচ তাঁর দেশেই কেন রোহিঙ্গা নিধনের মতো অশান্তির আগুন?—এমন প্রশ্ন যেন নিজের বেলায় না ওঠে, সে কারণেই মূলত শেখ হাসিনা চান বিএনপির সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সমালোচকদের মুখ বন্ধ রাখতে।

রাজনৈতিক সমঝোতা হলে খালেদা জিয়ার মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না—এমন প্রশ্ন করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি আদালতের ওপর নির্ভরশীল। তবে আমরা সংলাপ করব, ব্যর্থ হব, তারপর আবার সংলাপ করব। আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গতকাল শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে চিঠি দিয়ে সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। সিইসিকে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘৮ নভেম্বরের পরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংলাপের বিষয়টি আবারও বিবেচনায় রয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসার ব্যাপারে ইচ্ছুক।’ এ অবস্থায় আজ রবিবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ওই চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়।

 

সূত্র: কালেরকন্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর