::আল হাছিব তাপাদার::
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রস্তুত করার ঘোষণা বহু আগেই দিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগ কিন্তু এরপরও জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের মাঝে নেই নির্বাচনী প্রস্তুতি। দিনদিন নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হানাহানিতে বেড়ে চলেছে দূরত্ব। চার নেতার নিয়ন্ত্রণে বিভক্ত হয়ে আছেন অঙ্গ সংগঠনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নেপথ্যে রয়েছে উপজেলা আওয়ামীলীগের দুই সদস্যের কমিটি ও স্থানীয় নির্বাচনগুলোর রেশ।
২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে সম্মেলনে লোকমান উদ্দিন চৌধুরী সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম হায়দর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের পর ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। আগামী জানুয়ারী মাসে উপজেলা আওয়ামীলীগের দুই সদস্যের কমিটি মেয়াদ উর্ত্তিণ হবে। কমিটির মেয়াদ উর্ত্তিণের সময় ঘনিয়ে আসার পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় প্রবীণ নেতাকর্মীরা রাজপথের কোন কর্মসূচিতে অতীতের মত উপস্থিত থাকতে দেখা যায়না। “একলা চলো” নীতি অবলম্বন করেই চলছেন বেশীরভাগ প্রবীণ নেতাকর্মী।
নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, র্দীঘদিন থেকেই চারজন দাপুটে নেতার নেতৃত্বে রয়েছে জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠন। এই চার নেতা হলেন, জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আহমদ আল কবির, ঢাকা উত্তর সিটির কাউন্সিলর রমনা শাহবাগ থানা আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল মুনির চৌধুরী ও সাবেক এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদারের অনুসারী উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দলকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রস্তুত করার ঘোষণা কেন্দ্র থেকে দেয়া হলেও জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগের কোন্দল অবসান করার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছেনা। দুই সদস্যের কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ করার কোন উদ্যোগ নেই। চার নেতার মধ্যে মতবিরোধ ও দূরত্ব দিনদিন বেড়ে চলছে। ফলে আগামী সংসদ নির্বাচনে জকিগঞ্জ-কানাইঘাট আসনে আওয়ামীলীগ পরাজয়ের ভার বহন করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে একাধিকজনের ধারণা। জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগকে নিয়ন্ত্রণকারী চার নেতার মতবিরোধের কারণ হিসেবে নেতাকর্মীরা চিহ্নিত করেছেন, বিগত উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইসহ আওয়ামীলীগের দুই সদস্যের আংশিক কমিটি।
দলীয় সূতে জানাগেছে, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে প্রার্থী বাছাই নিয়ে মতবিরোধের পর দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করেই চার নেতার মধ্যে মারাত্মক বিভক্তি শুরু হয়। এই বিভক্তির কারণেই আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থীরা স্থানীয় একাধিক নির্বাচনে পদে পদে পরাজিত হয়েছেন।
২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ পরাজিত হন। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম আলী হায়দর ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে মহিলা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী সাজনা সুলতানা হক চৌধুরী পরাজিত হন। ২০১৬ সালে ইউপি পরিষদ নির্বাচনে বারহাল ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মিসবাহ জামান তালুকদার, সুলতানপুর ইউপিতে ইকবাল আহমদ চৌধুরী একল, মানিকপুর ইউপিতে আবু জাফর মো. রায়হান পরাজিত হয়েছেন। সর্বশেষ চলতি বছরে বিরশ্রী ইউপির উপ-নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আব্দুস সাত্তার পরাজিত হয়েছেন। অথচ জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের একটি ভোট ব্যাংক হিসেবে অতীতে পরিচিত ছিলো। এ পরাজয়গুলোর পর একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেই মতবিরোধকে চাঙ্গা করে তুলেন বলে নেতাকর্মীদের দাবী। তাদের এ মতবিরোধ এখন তৃণমূল পর্যন্ত পৌছে গেছে।
এদিকে চলতি বছরে জকিগঞ্জ উপজেলা এবং পৌরসভা যুবলীগের আহবায়ক কমিটি অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। অনুমোদিত এ দুটি কমিটির গঠনের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে মাসুক উদ্দিন গ্রুপের নেতাকর্মীদের বাদ দেয়া হয়েছে বলে একাধিকজন অভিযোগ করেছেন। এ নিয়েও দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউপির সম্মেলন নিয়েও দেখা দিয়েছে গ্রুপিংয়ের প্রভাব। মর্যাদাপূর্ণ পদপদবী নিয়ে চার বলয়ের মধ্যে চলছে টানাটানি। পদপদবী পেতে দাবী করা হচ্ছে টাকা। গত সপ্তাহে ইছামতি কলেজের সম্মেলনে পদপ্রত্যাশীদের জীবন বৃত্তান্তের সাথে প্রকাশ্যে বড় অংকের টাকা আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি সময়ে এ নিয়েও গৃহদাহ বেড়ে ঘরের শত্রু বিভিষণে রূপ নিয়েছে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জকিগঞ্জ আওয়ামীলীগকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারলে আসন্ন সংসদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার গুঞ্জনো রয়েছে।
জকিগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ জানান, কোন্দল নিরসনের চেষ্ঠা করা হচ্ছে। জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের দুই সদস্যের কমিটি মেয়াদ শেষের দিকে চলে আসলেও উপজেলা আওয়ামীলীগ পূর্ণাঙ্গ কমিটি জেলায় জমা দিতে পারেনি। যদি তাঁরা জমা দিতেন তাহলে অনেক আগেই অনুমোদন করা হত।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী সিলেট জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান প্রত্যাশী বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ জানান, আমি দলের এক কর্মী হিসেবে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের তৃণমূল নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। বিগত দশম সংসদ নির্বাচনে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। পরে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়ায় আমি পালন করেছি। উপজেলা আওয়ামীলীগ প্রায় ৩৪ মাস থেকে দুই সদস্যে বিশিষ্ট। যে দুজন উপজেলা আওয়ামীলীগের দায়িত্বে রয়েছেন তাঁরা ত্যাগী কোন নেতাকর্মীকে মূল্যায়ন করছেন না বলে অভিযোগ পেয়েছি। জামায়াত বিএনপিকে নিয়েই তারা আওয়ামী রাজনীতি করেন। চলতি বছরে যুবলীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য উদ্দেশ্যমূলক কারণে যুবলীগের ত্যাগী কর্মীদের বাইরে রেখে দুটি কমিটি করেছেন। যিনি এই দুটি কমিটি কেন্দ্র থেকে অনুমোদন করিয়েছেন তিনি দলের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলকে সংগঠিত করতে এখনো মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আহমদ আল কবির জানান, তিনি উন্নয়নের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ৭০ সালের নির্বাচন থেকে তাঁর রাজনীতি শুরু হয়েছে। কোন গ্রুপিংয়ের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাসী নয়। জকিগঞ্জের উন্নয়নের রাজনীতিকে বিশ্বাস করেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলকে শক্তিশালী করার চেষ্ঠা চালাচ্ছি। পৌরসভা ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে কোন দূরত্ব দেখা দেয়নি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের লক্ষে উপজেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দ্রুত হোক সেই প্রত্যাশা আমিও করি।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ঢাকা উত্তর সিটির কাউন্সিলর ফয়জুল মুনির চৌধুরী জানান, আমি আমার নির্বাচনী এলাকা জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের তৃণমূল নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছি। আওয়ামীলীগ বড় রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কোন্দল থাকতে পারে। কিন্তু হানহানি করা ঠিক নয়। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামীলীগকে কেউ হারাতে পারবেনা। আগামী সংসদ নির্বাচনে দল যাকে প্রার্থী দিবে আমরা তাঁকেই বিজয়ী করবো।
জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী জানান, উপজেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জেলায় অনেক আগেই জমা দেয়া হয়েছে। সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ অনুমোদন করছেন না। তবে খুব দ্রুত অনুমোদন হবে বলে তিনি আশাবাদী।
উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাকিম হায়দর বলেন, উপজেলা আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি খুব দ্রুত হয়ে যাবে।
উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল ইকবাল আহমদ চৌধুরী একল বলেন, বিগত নির্বাচনে দলের নির্দেশে মনোনয়ন প্রত্যাহারকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ তৃণমূলের কোন্দল নিরসনের চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন কিন্তু আওয়ামীলীগের দু সদস্যে কমিটি পাত্তা দিচ্ছেনা। বিগত ইউপি নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি লোকমান উদ্দিন চৌধুরী নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকাশ্যে লাঙল প্রতিক নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করেছেন। একটি দলের সভাপতির দায়িত্বে থেকে অন্যদলের প্রতিকে প্রচারণা গঠনতন্ত্র বিরোধী। এ কারণে তিনি আওয়ামীলীগের সভাপতি থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে দুই সদস্যের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করতে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
Leave a Reply