আল হাছিব তাপাদার:: ভারতের সীমান্তঘেষা সিলেটের দুটি উপজেলা জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট নিয়ে গঠিত হয়েছে সিলেট-৫ আসন। প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ আসন থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন আওয়ামীলীগ প্রার্থী ৩ বার, জাতীয় পার্টির প্রার্থী ৪ বার, বিএনপির প্রার্থী ১ বার, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী ১ বার ও জামায়াতের প্রার্থী ১ বার।
সিলেটের সবকটি আসনের মধ্যে সীমান্ত এলাকার এ আসনটি জামায়াতের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এই আসন থেকে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য চারদলীয় জোটের প্রার্থী মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী। তখনকার সময়ে এই আসনে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী না থাকার অজুহাতে জামায়াত সহজেই জোট থেকে আসনটি ভাগিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বিএনপিতে রয়েছেন হেভিয়েট প্রার্থী কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন। এ কারণে বিএনপি নেতাকর্মীরা জামায়াতের প্রার্থীকে ভোটের মাঠে ছাড় দিতে নারাজ। যেকোন মূল্যে বিএনপি আসনটি নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া। বিএনপির জোটের দুই প্রার্থী ভোটের মাঠে সমান তালে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। জামায়াতের প্রার্থীকে নিয়ে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে চরম অস্বস্তি ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে বির্তকিত ভূমিকায় থাকা বদর নেতা মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী এবারের নির্বাচনে সিলেট-৫ আসন থেকে বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। তিনি বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করে নিজেকে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী দাবী করে ভোটারের কাছে দোয়া চাইছেন। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে ৪ দলীয় জোট গঠনের আসনটিতে বিএনপির কোন হেভিয়েট নেতা না থাকায় জামায়াত সহজেই জোটের কাছ থেকে আসনটি পেয়েছিলো। কিন্তু এবারের নির্বাচনে জামায়াত আগের মত কাবু করতে পারবে না। বিএনপিতে জনপ্রিয় প্রার্থী রয়েছেন। বিগত সময়ে জামায়াত নেতা জোটের প্রার্থী হয়ে সংসদে গেলেও বিএনপি নেতাকর্মীদের এড়িয়ে চলেছেন। এতে বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মী মধ্যে অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ছিলো। এ নির্বাচনে আবারো জামায়াত জোটের কাছে আসনটি চেয়ে বসায় বিএনপি জামায়াতের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে।
বিগত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এ আসনের দুটি উপজেলা থেকে বিএনপির দুজন চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ প্রার্থীকে হারিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুটি উপজেলায় জামায়াত তেমন কাবু করতে পারেনি। দুটি উপজেলায় জামায়াতের দুজন নেতা ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জামায়াতের দায়িত্বশীল সূত্রের সাথে কথা বলে জানাগেছে, বৃহত্তর সিলেটের সবকটি আসনের মধ্যে এ আসটিতে জামায়াতের শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থীকে দিয়ে আসন উদ্ধার করা সম্ভব। জামায়াত বিএনপি জোটের কাছে যে কয়েকটি আসন চেয়ে এরমধ্যে সিলেট-৫ আসনটি রয়েছে। বিএনপি এ জামায়াতকে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। এ জন্য মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন।
বিএনপি সমর্থক কয়েকজন ভোটাররা মনে করেন, সিলেট-৫ আসনের মানুষ জামায়াতকে মেনে নিবে না। জামায়াতের প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের সময় বির্তকিত ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপিতে যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও বদর নেতা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচনে লড়লে এটা হবে কলংঙ্কজনক অধ্যায়। জামায়াতকে আসন দেয়া মানে পরাজয় নিশ্চিত করা। আওয়ামী জোটের কাছ থেকে আসন উদ্ধার করতে বিএনপির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত এমন মন্তব্য তাদের।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনেও পাশে ছিলো না জামায়াত নেতাকর্মীরা। জোটের সকল কর্মসূচিতে জামায়াতের প্রতিনিধিরা ছিলেন দায়সারা গোছের। শুধু তাই নয়, এই সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জোট বা বিএনপির যে কোনো কর্মসূচিতেই জামায়াতকে গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে। বিগত চার বছর ধরে জামায়াত সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আঁতাত করে চলছে। তারা মনে করেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনে বিএনপির বিজয়ের ক্ষেত্রে জামায়াত-ই বড় বাধা। জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হয়েও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে এটা দুঃখজনক ঘটনা। জামায়াতের হাতে ধানের শীষ তুলে দিলে ভোটাররা যুদ্ধাপরাধী বলে ধানের শীষ প্রতীককে বর্জন করবে। ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে বিএনপির দলীয় প্রার্থীর বিকল্প নেই বলে তাদের দাবী।
বিএনপি সমর্থক রিপন আহমদ বলেন, জাতীয় স্বার্থে জামায়াতের দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করা উচিত। সিলেট-৫ আসনে তারা প্রার্থীতা চেয়ে ভুল করেছে। যেখানে বিএনপি বিশাল ভোটব্যাংক নিয়েও এই সরকারের আমলে কঠিন পরিস্থিতে টিকে থাকতে হচ্ছে, সেখানে যুদ্ধপরাধীর দল জামায়াত ভোটের মাঠে টিকে থাকার তো প্রশ্নই আসে না। বদর নেতাকে ধানের শীষের প্রার্থী করা হলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে। ভবিষ্যতেও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির দলীয় প্রার্থী কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, সিলেট-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতিক নিয়ে বির্তকিত জামায়াত নেতা ফরিদ উদ্দিনকে মানুষ মেনে নিবে না। জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের কোথাও জামায়াতের অস্তিত্ব নেই। জামায়াত নেতা যদি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন তাহলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বিজয়ে তেমন কোনো বেগ পেতে হবে না। বদর নেতার হাতে ধানের শীষ তুলে দেয়া হলে বিএনপির প্রতীকটাও বির্তকিত হবে। জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে বিএনপির যে অবস্থান তৈরী হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপির হাই কমান্ড যদি বদর নেতার হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেয় তাহলে আমরা কিভাবে বদর নেতার পক্ষে ভোট চাইবো?
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, জামায়াত নেতা মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বদর কমান্ডার ছিলেন। ২০১০ সালে ৪০ জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর তালিকার মধ্যে ২৪ নম্বরে রয়েছে তার নাম। সম্প্রতি সময়ে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ এক সাক্ষাৎকারে ফরিদ উদ্দিনকে সরাসরি ‘আলবদর বাহিনীর কমান্ডার’ অভিহিত করে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত নেতা ফরিদ উদ্দিন সিলেট শহরতলি খাদিমনগরের আলবদর বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব হেড কোয়ার্টারে যোগ দিয়ে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৩/৪ বছর ফরিদ উদ্দিন আত্মগোপনে ছিলেন।
এ ব্যাপারে মাওলানা ফরিদ উদ্দিনের সাথে যোগাযোগের চেষ্ঠা করেও সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে, এ আসনে জামায়াতের প্রার্থীকে প্রত্যাখান করে ইসলামী দলগুলো ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে। জামায়াতের কোন প্রার্থী ভোটের মাঠে থাকলে ইসলামী দলগুলো আলাদা প্রার্থী রাখে। এবারো বিএনপি জোটের শরীকদল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এ আসনে জামায়াতের বিপরীতে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুককে প্রার্থী করেছে। ভোটারদের ধারণা শেষ পর্যন্ত বিএনপির কেউ প্রার্থী হলে জমিয়ত তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিতে পারে।
Leave a Reply