নিজস্ব প্রতিবেদক, জকিগঞ্জ টুডে:: ৫ম ধাপে অনুষ্ঠিত সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন পরাজিত চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীরা। তাদের অভিযোগ, আর্থিক চুক্তিতে জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিবের যোগসাজশে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রিজাইডিং অফিসারদের নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট নির্দিষ্ট প্রার্থীদের পক্ষে সিলমারা ব্যালট পেপার ভোটের বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা দরজা বন্ধ করে ব্যালটে সিল মেরেছেন এবং দুপুরের খাবারের বিরিয়ানির প্যাকেটের ভেতর কৌশলে কেন্দ্রে ঢোকানো হয়েছে বেশকিছু সিলমারা ব্যালট পেপার। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের দিন উপজেলার প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা এক রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নিয়ে গাড়িযোগে সকাল থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়ে সিলমারা ব্যালট বাক্সে ঢুকান এবং খালি ব্যালট পেপার অনুগত প্রিজাইডিং অফিসারকে সরবরাহ করে আসেন প্রয়োজন অনুযায়ী সিল মেরে বাক্সে ভরার জন্য। একপর্যায়ে নির্বাচনের দিন ৫ জানুয়ারি নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব ও রিটার্নিং কর্মকর্তা আরিফুল হককে সিলমারা ও খালি ব্যালট পোপার এবং নগদ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রার্থীদের আরও অভিযোগ, ভোটারের তুলনায় কম ব্যালট পেপার নিয়ে নির্বাচন শুরু করার সময় প্রার্থীরা প্রশ্ন তুললে ‘ব্যালট কম ছিলো, বাকি ব্যালট নিয়ে নির্বাচন কর্মকর্তা-রিটার্নিং কর্মকর্তা আসছেন’ বলে আশ্বস্ত করেন প্রিজাইডিং অফিসার। ভোট শুরু থেকেই প্রার্থীদের এজেন্টরা ছিলেন অসহায়। প্রতিবাদ করলে বা প্রার্থীদের কাছে খবর পৌঁছালে ভোটবাক্স চুরির মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়েছিলেন প্রতি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। প্রিজাইডিং অফিসারের বন্ধ দরজার সামনে ছিল পুলিশের কড়া পাহাড়া। প্রার্থীরা জানতে চাইলে ওই পুলিশ সদস্য বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভালোর জন্যই স্যার দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।
আজ (১৩ পরাজিত) বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন পরাজিত ৭ জন চেয়ারম্যান ও ২৯ জন মেম্বার প্রার্থী। তারা দ্রুত জকিগঞ্জের ওই ৯টি ইউনিয়নের ভোটের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একইসঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব, জকিগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার আরিফুল হককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভোট জালিয়াতির রহস্য উদঘাটনপূর্বক জড়িত অন্যদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
তারা জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে পৃথক ও যৌথভাবে লিখিত অভিযোগ করেছেন তারা। নির্বাচন কমিশন কর্নপাত না করলে আইনি লড়াইয়ে নামবেন তারা। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে রিট করবেন বলেও আভাস দেন পরাজিত প্রার্থীরা।
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর পরাজিত প্রার্থীরা বলছেন- দল বা প্রতীক দেখে নয়, যে প্রার্থীর সাথে টাকার চুক্তিতে মিলেছে, তাকেই বিজয়ী করেছে এই সিন্ডিকেট। নির্বাচনের আগে প্রত্যেক প্রার্থীকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমানের পক্ষ থেকে ফোন করা হয়েছিলো। কারও কারও সাথে সাক্ষাতেও কথা বলা হয়। প্রস্তাব দেয়া হয়, এক লাখ টাকায় একশ ভোট বাক্সে ভরে দেয়া হবে। নির্বাচনী ব্যালটে গড়মিল হলেও সামলে নিবেন নির্বাচন কর্মকর্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে পরাজিত প্রার্থীদের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ৯ নং মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের লাঙল প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. মাহতাব হোসেন চৌধুরী। এরপর একে একে অভিযোগ তুলে ধরেন পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ৫ নং জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের হাসান আহমদ, ৭ নং বারঠাকুরী ইউনিয়নের মো. নাছির উদ্দিন (নাসির), ৯ নং মানিকপুর ইউনিয়নের মো. জাহাঙ্গীর শাহ চৌধুরী হেলাল, ৮ নং কশকনকপুর ইউনিয়নের মো. আব্দুর রাজ্জাক রিয়াজ, ১ নং বারহাল ইউনিয়নের বুরহান উদ্দিন রনি ও ৬ নং সুলতানপুর ইউনিয়নের মোঃ জালাল উদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, জকিগঞ্জ উপজেলার ওই ৯টি ইউনিয়নের দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমান সাকিব। বরহাল এবং কাজলশাহ ইউনিয়নে উপজেলা কৃষি অফিসার আরিফুল হক, বিরশ্রী এবং খলাছড়া ইউনিয়নে উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. ওয়াজেদ আলী, জকিগঞ্জ সদর, সুলতানপুর এবং বারঠাকুরী ইউনিয়নে সাদমান সাকিব নিজে ও কসকনাকপুর এবং মানিকপুর ইউনিয়নে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা প্রকৌশলী মনসুরুল হক। সাদমান সাকিবের নেতৃত্বে ওই তিন রিটার্নিং অফিসারের যোগসাজশে ঘটেছে এই ভোট জালিয়াতি। তারা নিজেরা বাক্সে সিলমারা ব্যালট ঢুকিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন। প্রায় কেন্দ্রেই ভোটের হিসাবে গড়মিল হয়েছে। নির্বাচনের দিন নির্বাচনী অফিস থেকে সাদমান সাকিব ও আরিফুল হক তাদের পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে সিল মেরে সেই ব্যালট নিয়ে গাড়িযোগে বের হয়ে সকাল থেকে ওই ৯টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটি কেন্দ্রে যান। তারা কেন্দ্রে ঢোকার সাথে সাথে ’জরুরি অবস্থার’ মতো কড়াকড়ি আরোপ করে পুলিশ। তারা কেন্দ্রে অবস্থান করা ১০-১৫ মিনিট প্রার্থীদেরও কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি। একপর্যায়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে নির্বাচনের দিন বিকাল ৩টা ৪০ মিনিটে তাদের ব্যবহৃত গাড়িসহ (ঢাকা মেট্রো- ট- ১৩-৭০২৮) তাদের আটক করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সীল মারা ৪শ’ ও সিলছাড়া ৪শ’ ব্যালট পেপার, ব্যালট বইয়ের মুড়ি ৪টি, ব্যালট বাক্সের লক ৮টি এবং নগদ ১ লাখ ২১ হাজার টাকা ও ফেনসিডিলের খালি বোতল উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তাদের গ্রেপ্তার করে জকিগঞ্জ থানায় নেয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনে মামলা করা হয়। পুলিশ তাদের আদালতে হাজির করলে আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এখন তারা দুজন কারাগারে রয়েছেন। আর এই সিন্ডিকেটের আরো দুজন শীর্ষ পর্যায়ের মাস্টারমাইন্ড পলাতক রয়েছে। পরাজিত প্রার্থীদের ভাষ্য, ‘যেখানে উপজেলা নির্বাচন অফিসার এবং রিটার্নিং অফিসার ব্যালটসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, সেখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রকাশিত ফলাফল কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায়।’ তারা বলেন, এই নির্বাচন কর্মকর্তা নির্বাচনের আগের রাতে ৪ বার প্রিজাইডিং অফিসার বদল করেছেন। যে জালিয়াতিতে রাজি হয়নি, তাকেই বাদ দিয়ে অনুগতদের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ভোটের দিনের অসাহয়ত্বের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন একাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থী। তাদের মধ্যে টানা কয়েক টার্ম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন- এমন প্রার্থীও রয়েছেন। তারা বলেন, ‘এমন নির্বাচন জীবনেও দেখিনি।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত একজন মেম্বার প্রার্থী জানান, তার কাছে ওই নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি এসেছিলেন। এক লাখ টাকা দিলে একশ’ ভোট বাক্সে দিয়ে দেয়া হবে বলে প্রস্তাব দেয়া হয়। তবে ওই প্রার্থীর কাছে ভোটের এই নতুন হিসেব মিলছিলো না। কীভাবে নির্বাচন কর্মকর্তা ভোট দিয়ে দিবেন- তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। পরে তিনি আর চুক্তিতে যাননি। তাকে বলা হয়, ৫ লাখ দিলে ৫শ ভোট দেয়া হবে। তিনি বলেন, তার কেন্দ্রে চেয়ারম্যান প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন, তার চেয়ে মেম্বর প্রার্থীদের ভোটের সংখ্যা বেশি। সেটা কীভাবে সম্ভব?- প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে পরাজিত প্রার্থী জুনায়েদ আহমদ বলেন, তাকে ফোন করে টাকার কথা বলা হয় নির্বাচন কর্মকর্তা সাদমানের বরাত দিয়ে। একপর্যায়ে তার বাড়িতে আসেন নির্বাচন কর্মকর্তার লোক। তিনি প্রতারক মনে করে ভ্রুক্ষেপ করেননি। যাওয়ার সময় তারা জুনায়েদকে বলে যান, ‘ট্যাকা দিলে পাস করাইয়া দিতাম, নইলে ফেল।’
Leave a Reply