স্মৃতি চারণ: জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ডিগ্রি করণ

মোস্তফা জামান পাটওয়ারী শান্ত::
১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৩ বছর পর ১৯৮৮ সালে সরকারি করণ করা হয় এই কলেজকে। সরকারি করণ করার পর উক্ত কলেজে ডিগ্রি ও অনার্স চালুর বিষয় দাবী উঠে ১৯৯৮ সালে,২০০১ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি আসলেও কলেজে উন্নতিকরণের কোন সাড়া পায় নি। এরপরেই বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন সময় ডিগ্রি ও অনার্স কোর্স বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করে, আন্দোলনরত অবস্থায় ২০১৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক এম,পি জনাব হাফিজ মজুমদার সাহেবের আমন্ত্রণে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কলেজে ডিগ্রি করণের আশ্বাস দেওয়ার পর দীর্ঘ চার বছর পার হয়ে গেলেও কোন ফলাফল না পাওয়ায় এক যাক তরুণ শিক্ষার্থী ফের আন্দোলনে নামে গুলজার ও শান্ত পাটওয়ারীর নেতৃত্বে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র ঐক্য পরিষদ এর ব্যানারে।

সেই আন্দোলনরত অবস্থায় কিছু স্মৃতি ও কথা:
২১ ডিসেম্বর ২০১৬ আমি গুলজার ও আকাশ স্বমনয়ে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কলেজে সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র ঐক্য পরিষদ কমিটি গঠন করি।
তারপরেই শুরু হয় বিভিন্ন গ্রুপের ইন্দন জাল বিছানো ও আমাদের ভয়ভীতি দেখানো এরমধ্য দিয়ে ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ প্রথম মাসিক সভায় ডিগ্রি করণের জন্য আন্দোলনের প্রস্তাব আমি রাখি।

২৬ জানুয়ারি সকলের সম্মতিক্রমে এক প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে গুলজার ও আমি বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করি (২ফেব্রু-গণস্বাক্ষর কর্মসূচি,৭ ফেব্রু-বিক্ষোভ মিছিল ও মানব বন্ধন,১৫ ফেব্রু-আমরণ অনশন কর্মসূচি।)।

২৯ জানুয়ারি গুলজার, আমি,জামিল ও কমিটির নেতৃবৃন্দ দের নিয়ে সিলেটে উচ্চ পদস্থ নেতাদের সাথে দেখা করার জন্য রওয়ানা দেই। সিলেটে প্রথমে আছাদ উদ্দিন(মহানগর আওয়ামীলীগ এর সাধারণ সম্পাদক)এর সাথে দেখা করি,এরপর শাব্বীর আহমেদ(সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান) সাইফুদ্দিন খালেদ (বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী) সাথে দেখা করি কথা বলি,জনাব সাইফুদ্দিন খালেদ আমাদের অনেক আশ্বাস দেন এবং কিছুটা আর্থিক সহায়তা করেন। তারপর দেখা করি, শামীম আহমেদ(জেলা পরিষদ এর সদস্য) সহ বিভিন্ন নেতা কর্মীদের সবার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছি কিন্তু শান্তনা পাইনি এমনকি অনেকের কথায় আমাদের সকলের আন্দোলনের মনোভাব টাই নষ্ট হয়ে গেছিল তা ও আমরা থেমে যাই নি।

আসার প্রাক্কালে আমার বড় ভাই আসাদুজ্জামান সুজন এর সাহায্যে প্রথম আলো বিভাগীয় প্রধান প্রিয় উজ্জ্বল মেহেদি ভাইয়ের সাথে দেখা করি,এবং উনি সর্বাত্মক মিডিয়া সাপোর্ট ও সার্বিক সহযোগীতার আশ্বাস দেন।

৩০ জানুয়ারি আমাদের আন্দোলন চালানোর জন্য যে আর্থিক সহযোগীতার দরকার সেই ব্যবস্থা হয় নি,আমাদের টেনশন বেড়ে গেলো প্রায় পাগলের মতো অবস্থা,এতো বড় আন্দোলন চালাবো কিভাবে। তাই সেই দিন জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই কলেজ সবার তাই বিভিন্ন মহল থেকে আমরা আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার জন্য টাকা উত্তোলন করবো

১ ফেব্রুয়ারী উপজেলা পরিষদে বিভিন্ন কর্মকর্তা- কর্মচারী বৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে আমাদের কর্মসূচির চিঠি বিতরণ করি ও সকলের সহযোগীতা কামনা করি।কিন্তু আশানুরূপ,কোন ফল পাই নি। এর মধ্যে হটাত দেখা, জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদের সম্মানিত অর্থ সম্পাদক ডাঃ হাবিবুল্লাহ মিছবাহ ভাইয়ের সাথে। উনার পরামর্শক্রমে যোগাযোগ করি,জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক ও সমাজসেবী জনাব ইকবাল তালুকদার এর সাথে,আল্লাহ অশেষ কৃপায় ইকবাল ভাই প্রতিশ্রুতি দিলেন আন্দোলনে সম্পূর্ণ ব্যয়ভার উনারা বহন করবেন।

২ ফেব্রু – কলেজ এর সামনে প্রধান সড়কে(জকিগঞ্জ-আটগ্রাম-সিলেট) গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করি। ৩ ফেব্রুয়ারী আবারো গুলজার,আমি, জামিল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দদের নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। লক্ষ্য মাসুক উদ্দিন আহমেদ(সহ সভাপতি,সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ) এর সাথে দেখা করা। এবং সিলেট-৫ আসন এর মাননীয় সাংসদ এর কাছে গণ স্বাক্ষরলিপি ও স্মারকলিপি প্রধান করা।

সিলেট আসার পর শুরু হলো আসল খেলা। জকিগঞ্জের বিভিন্ন কু-চক্রি মহল শুরু করলো আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা। এমনকি বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হতো কিন্তু সেইসব কিছুকে উপেক্ষা করে আমি আমার সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রাণপণ চেষ্ঠা করে যেতে থাকি।

৫ জানুয়ারি -বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আমাদের ৭ তারিখের মানব বন্ধন এ অংশগ্রহণ করার জন্য দাওয়াত করণের উদ্দেশ্যে আমার নেতৃত্বে আমরা ৪-৫ জন বের হয়ে পড়ি। সারাদিন না খেয়ে গাড়িতে ঝুলে হেটে জকিগঞ্জ উপজেলার সব কয়টা স্কুল-কলেজে যাই এবং দাওয়াত দেই।

৬ ফেব্রুয়ারি, সারাদিন ৭ তারিখের কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে ব্যস্ত থাকি। কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন বিষয়বস্তু ও আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি উল্লেখ করে লিফলেট করে একটা পিকাপ ভ্যানের মাধ্যমে আমরা ১০-১২ জন পুরো জকিগঞ্জ উপজেলা শো-ডাউন দেই ও প্রতিটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এর সাথে যোগাযোগ করি এবং লোকজনের মধ্যে লিফিলেট বিতরণ করি। রাত ৮ টা হটাত আমার ফোনে একটা কল আসে, আমাদের কোন এক শুভাকাঙ্ক্ষী কল দিছে, তখন শুনতে পাই আমাদের প্রোগ্রাম নষ্ট করার জন্য বিশৃঙ্খলা করার পরিকল্পনা।

কলেজের মধ্যে কোন জায়গায় লাঠি,ইট-পাঠকেল রাখবে কিভাবে আমাদের সাথে সংঘর্ষ বাধাবে। এই সব শুনে সত্যি ঘাবড়ে যাই, কিন্তু ভেঙ্গে যাই নি। আমাদের চিন্তায় আসে আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত কিন্তু অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে আগত শিক্ষার্থীদের কিভাবে নিরাপত্তা দিবো। সেই চিন্তায় সারা রাত ঘুমাই নি।

৭ ফেব্রুয়ারি সকালে আমার সহযোদ্ধা গুলজারের সাথে যোগাযোগ করে থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। থানায় যাওয়ার পর অফিসার ইনচার্জ কোনভাবেই আমাদের নিরাপত্তা দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। উনি বলছিলেন,৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী আসবেন উনারা সেটা নিয়ে ব্যাস্ত, উনারা নিরাপত্তা দিতে পারবেন না আমাদের কর্মসূচি স্থগিত রাখার জন্য। কিন্তু আমরা দমে যাওয়ার পাত্র নই। সাথে সাথে যোগাযোগ করি সিলেট জেলা আওয়ামীলীগ এর সহ সভাপতি মাসুক উদ্দিন ও জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ এর সভাপতি জনাব লোকমান উদ্দিন চৌধুরীর সাথে, এরপরক্ষণে কলেজ প্রাঙ্গনে প্রায় ২ গাড়ি পুলিশ নিরাপত্তা সদস্য দের দেখতে পাই। প্রোগ্রাম শুরু করার কথা সকাল ১১ টার সময়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসে প্রায় ৪০০ত শিক্ষার্থী, তখনি বাদে বিবাদ। আমাদের প্রোগ্রাম করতে দেওয়া হবে না। কারণ কি? প্রশ্ন করলে জানা যায়, সুরঞ্জিত সেন মারা যাওয়ায় শোক সভা করা হবে, উনারা কালো পতাকা নিয়ে এসেছেন। তখন আমরা বললাম ঠিক আছে,আমরাও আপনাদের শোক সভা করবো, কিন্তু আমাদের কলেজের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত কর্মসূচি পরপর ই শোক সভা করব। কিন্তু উনারা নারাজ।প্রায় উনারা মারামারির পজিশন চলে গেছেন, তখন ই হটাত করে জকিগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের বড় ভাইয়েরা এসে হাজির। ভাইদের হুংকারে প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন ডিগ্রি আন্দোলন বিরুধী ভাইয়েরা।

পরপর ই সুন্দর ভাবে আমরা আমাদের প্রোগ্রাম করি,জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে মানববন্ধন করে কলেজ প্রাঙ্গন থেকে বের হয় বিশাল বিক্ষোভ মিছিল,উক্ত মিছিল উপজেলার সামনের দিকে গিয়ে পুরো জকিগঞ্জ বাজার পদক্ষিণ করে আবারো মিছিল সহ কলেজে ফিরে আসি। এবং জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য যে খাবারের ব্যবস্থা করা হয় তা সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্টন করি।

আন্দোলনের সময় বাসায় যেতে প্রতিদিন রাত প্রায় ১১-১২ টা বেজে যেতো, তা নিয়ে কিন্তু বাড়িতে আমার উপর দিয়ে কম ঝড় যেতো না অনেক মাশুল দিতে হতো।
ওইদিন রাত ১ টার সময় আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে,জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র ঐক্য পরিষদ থেকে আগত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি ব্যানারে মাধ্যমে উনাকে স্বাগত জানিয়ে,স্লোগানের সহিত শুভেচ্ছা বিনিময় ও জকিগঞ্জ সরকারি কলেজে ডিগ্রি সহ অনার্স করণের প্রস্তাব রাখা, এবং জকিগঞ্জ পৌরসভা অডিটোরিয়ামে বিকালে যে প্রোগ্রামে তিনি যোগদান করবেন,সেখানে উনাকে গণস্বাক্ষর এর অনুলিপি স্মারকলিপি প্রদান করবো। যেই ভাবা সেই কাজ।

পরের দিন সকাল…….
৮ ফেব্রুয়ারি-সকাল ৬ টা, আমার মোবাইলে একটা কল আসে। জকিগঞ্জ থানা থেকে থানার এএসআই, আমাকে প্রশ্ন করলেন,আমরা প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি আটকাবো কি না, রাস্তায় কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবো কি না। আমি বললাম না, আমরা কোন আইনের পরিপন্থী কাজ করবো না, আর কখনো এরকম পরিকল্পনা করি না। কিন্তু উনি বললেন না আপনাদের সংগঠনের নামে অভিযোগ আসতেছে এবং আপনাদের সংগঠনের সভাপতিও এসবের সাথে জড়িত। আমি এক কথায় না করলাম, উনাকে বুঝিয়ে সবকিছু বললাম,কুচক্রীদের কথাও বললাম, তারপর উনি সবকিছু বুঝতে পেরে সহযোগীতা করার আশ্বাস দিলেন।

সকাল ৮ টা কলেজের পাশে শেওলা রাস্তার সামনে আমরা প্রায় ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী আমার নেতৃত্বে অবস্থান নেয়। অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর গাড়ি আসে এবং আমরা উচ্ছাসিত কন্ঠে উনাকে উনার আসাতে শুভেচ্ছা জানাই ও ডিগ্রি করণের প্রস্তাব রাখি। উনি গাড়ি থামিয়ে দেখছিলেন, গাড়ি থেকে হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে চলে গেলেন। তারপর আমরা যে যার মতো কলেজে চলে যাই। কিন্তু আমার আর বিশ্রাম নেই,মাননীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে কলেজের সমস্যা নিয়ে স্মারকলিপি লেখার জন্য আমার প্রিয় স্যার গোলাম মোস্তফা(বাংলা প্রভাষক) এর কাছে ছুটে যাই। স্যার আমাকে যেকোন সময় যেকোন কাজে সাহায্য করেন। স্যারের কাছ থেকে স্মারকলিপি রাফ নিয়ে, নিজে নিজের ল্যাপটপ এ বসে টাইপ করে,প্রিয় আরেক ভাই কাশেম ভাইয়ের কাছে ইমেইল করে দেই।

দুপুর ১ টা স্মারকলিপি প্রিন্ট করা হয়ে গেছে,গণস্বাক্ষর এর অনুলিপি রেডি করে কলেজে চলে যাই। ওইখান থেকে আবারো আমার নেতৃত্বে ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পৌরসভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমাদের সভাপতি ছাত্রলীগ হতে শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রীর পিছনে শো-ডাউন এ গেছেন।

এর মধ্যে ২ টা থেকে বসে আছি,বিকাল ৪ টা বেজে গেছে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আসার খবর নাই। ক্ষিধায় অবস্থা বেহাল আগের দিন থেকে ভাত খাই নাই এসবের চিন্তায়। যাক অনেক্ষণ পরে বিকাল ৫ টায় উনি আসলেন। আসার সাথে সাথে আমাকে স্মারলিপি নিয়ে উনার হাতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো আমিও দিলাম উনি কলেজ সম্পর্কে আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন, তারপর বললেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন আমাদের কলেজে যেনো শীঘ্রই ডিগ্রি সহ অনার্স চালু হয়।
৯ ফেব্রুয়ারি -সকাল ৮ টা জরুরী ভিত্তিতে ড.আহমেদ আল কবিরের সাথে দেখা করার জন্য গুলজার আমি ও আরো ২ জন রওয়ানা দেই।

সকাল থেকে অনেক অপেক্ষার পর উনার দেখা পেলাম, ড.আহমদ আল কবির সাহেব আমাদের কিছু পরামর্শ দিলেন এবং বললেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করার জন্য।

কিন্তু আমাদের কাছে কোন টাকা নেই, এই দুঃখ কাকে বলব, নিজেরা যা নিয়ে আসলাম তা ও শেষ। প্রায় নিরুপায়, বাসায় বলতে পারতেছি না। কিন্তু সিলেটে থাকতে হবে। তাই আর কিছু না ভেবে সিলেটে আমাদের যার যার আত্মীয়র বাসায় থেকে গেলাম।
১০ তারিখ শনিবার সরকারি অফিস বন্ধ, তাই জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান সম্ভব না। তাই সেদিনো থাকতে হবে সিলেটে। কিন্তু নিজেরা আছি আর্থিক সমস্যায়, এরমধ্যে আছি চিন্তায় আমাদের আন্দোলন সফল হবে কি না। ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরণ অনশন কর্মসূচি কিভাবে পালন করবো। আমরা ৩ জন চিন্তায় চিন্তায় খালি পেটে সারাদিন পুরো সিলেট টাউন হাটছি, এরমধ্যে দেখা প্রিয় ভাই রুহুল আমিন এর সাথে, আমাদের সাংসদ এর কাছের মানুষ। উনি আমাদের দেখে বুঝতে পারলেন সারাদিন আমাদের খাওয়া-দাওয়া হয় নি। উনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে রেষ্টুরেন্ট এ বসে খাওয়ালেন,তারপর উনার সাথে করে নিয়ে গেলেন শিবগঞ্জ মাননীয় এম,পির বাস ভবনে। আমরা এম,পি মহোদয়ের সাথে দেখা করলাম, কথা বললাম। আবারো প্রস্তাব রাখলাম-দেখুন আপনি আমাদের এম,পি আপনি ই পারবেন আমাদের জন্য কিছু করতে, ১৫ তারিখের ভিতরে যদি কিছু না হয় তাহলে মনে রাখবেন ১৫ তারিখে কলেজে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে,আর সেই জন্য দায়ী থাকবেন আপনারা। এই কথা বলে চলে আসি আমরা ওইখান হতে। সেখান থেকে বএরএর হয়ে শুনতে পাই, জকিগঞ্জ এর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এর কাউন্সিলর ফয়জুল মুনির সিলেটে। রাত বাজে এগারোটা, কিন্তু আমাদের যে উনার সাথে দেখা করা উচিত। কারণ আমাদের
মনে অশান্তি,কার কাছে গেলে আমাদের কলেজে ডিগ্রি হবে। এই ভাবনাই আছি। যদি উনার কাছে গেলে কোন উপায় পাওয়া যায় সেই লক্ষ্যে ছুটে গেলাম পকেটে টাকা নাই। ৩ জন ই প্রায় ১ ঘন্টা হেটে উনার সাথে দেখা করার জন্য গন্তব্য স্থলে পৌছালাম। কিন্তু তিনিও সবার মতো একি বুঝ দিলেন চালিয়ে যাও আর পরামর্শ দিলেন শিক্ষামন্ত্রীর বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের জন্য বললেন ।

এবং আসার সময় কিছু টাকা দিয়ে বললেন বাবারা তুমরা অনেক কষ্ট করে আমার সাথে দেখা করতে আসছো কিছু খেয়ে নিয়ো আর স্মারকলিপি প্রিন্ট করতে যে টাকা খরচ যাবে তা চালিয়ে নিও। যাক একটু হলেও ভালো লাগলো,একটা সাহায্য পাওয়া গেলো।

১১ ফেব্রুয়ারি-আমরা স্মারকলিপি রেডি করে মানবাধিকার কর্মী সুহেল তালুকদার ভাইয়ের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করি।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে বের হয়ে শুনতে পাই গোলাপগঞ্জ কি একটা সমস্যার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট। এ কি বিপদ? এদিকে ১৫ তারিখে আমাদের আমরণ কর্মসূচী সব কিছু প্রস্তুত করতে হবে, কিন্তু ধর্মঘটের জন্য কোনভাবেই সম্ভব না। আর পকেটে যে টাকা আছে তা দ্বারা সিলেট টাউনে তো থাকা কোন ভাবেই সম্ভব না। কি আর করার নিয়তি ভেবে ওই দিন সিলেতে থেকে বিভিন্ন মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ করলাম প্রিয় উজ্জ্বল মেহেদী ভাইয়ের সাহায্যে। এবং কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা হয়ে গেলো।

পরেরদিন মানে ১২ তারিখ ধর্মঘট এড়িয়ে ২-১ ট গাড়ি চলছে। আর আমিরাও আজকে কোন ভাবে সিলেটে থাকা যাবে না যেভাবেই হোক জকিগঞ্জ এ আসতে হবে। তাই কদমতলী আসলাম। দুঃখের বিষয় এখানে জকিগঞ্জ রোডে কোন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তার একপাশে নিরুপায় ভাবে বসে থাকলাম। তখন হটাত দেখলাম গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি লেগুনা একটা আসতেছে। আমরা তক্ষণাত কিছু না ভেবে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি, একজন আরেকজনকে বলতেছি যেখানেই যাক না কেন গাড়ি হয়ে আমাদের নেবে নয়তো মেরে ফেলবে।

নাহ গাড়ি এসে আমাদের সামনেই থামলো ড্রাইভার ছিল পরিচিত তাই বেগ পেতে হলো না উঠে পড়লাম সিলিন্ডার ভরা গাড়িতে সিলিন্ডারে উপরে কোনভাবে শুয়ে মাথা নিচু করে বসে অনেক কষ্টে জকিগঞ্জ প্রবেশ করলাম। ১৩ এপ্রিল সকাল ঘুম থেকে উঠে কিছু লিফলেট নিয়ে বের হয়ে পড়ি মুন্সিবাজারে উদ্দেশ্যে। বলে রাখা বাহুল্য,ওইখানে সেদিন আল্লামা শফি হেলিকপ্টারে মুন্সিবাজার মাদ্রাসা আসবেন। তাই সেইখানে লাখো মানুষের ভিড়। জনসংযোগ এড় উদ্দেশ্যে আমি আমার সাথে আরো ৩ জন সহযোগী নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আমরা আমাদের লিফলেট বিলি করে আসার সময় আল্লামা শাফীর দোয়া করছিলেন হাজারো মানুষের সাথে আমিও নিজের দুখানা হাত তুলি এবং সঙ্গীদেরো বলি দোয়া করো কলেজের জন্য। নিজের মনের অজান্তেই কান্না করি,হে আল্লাহ আমাদের দাবী পূরণ করে সম্মান টা বাচাও। দুয়া করে, চলে আসি। রাত ৮ টায় জকিগঞ্জ বাজারে এসে পৌছাই,এবং আমরণ অনশন করার জন্য ডেকোরেটার্স এর সাথে কথা বলে রাত ৯ টার সময় বাসায় এসে ডুকি। হটাৎ ই অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন আসে আমার মোবাইলে, শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যম হতে, আমাকে হটাৎ কে একজন বলে আর আমরণ অনশন করতে হবে না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তুমাদের কলেজে ডিগ্রি মৌখিক ঘোষণা করে দিছেন। তখন খুশিতে একটা লাফ দেই কান্না করে ফেলি। পরে উনি পরিচয় দিলেন উনার নাম আব্বাস, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর পিএস।
প্রথমেই আমি আমার সভাপতি গুলজারকে ফোন দিলাম উনিও বললেন উনাকে ফোন দেওয়া হইছে এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আমাদের দেখা করার সুযোগ করে দিছেন ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার দিকে আমানউল্লাহ কনভেনশন সেন্টারে।

১৪ ফেব্রুয়ারি, আমরা জল্পনা কল্পনা করে আমি নিজের হাতে (প্রিয় বাংলা প্রভাষক গোলাম মোস্তফা স্যারের)সাহায্য নিয়ে অভিনন্দন পত্র বানিয়ে আমরা কলেজ থেকে গাড়ি নিয়ে ছেলে ও মেয়ে ২ গাড়ি প্রবাসীদের একটি গাড়ি নিয়ে উনার সাথে সাক্ষাৎ করি। সেদিন উনি বলেছিলেন, আমি ই শিক্ষামন্ত্রী আমি বলছি ডিগ্রি হয়ে গেছে হয়ে যাবে,আগামী মাস মানে মার্চ মাসে এসেই ডিগ্রি আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধন করবেন।
আমরা তো মহাখুশি,ওইদিন সিলেট থেকে এসে পরেরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি আমরণ অনশন এর স্টেজ এ আমরা আনন্দ মিছিল ও মিষ্টিমুখ কর্মসূচি পালন করি। অনেকটাই খুশি ছিলাম খারাপ তখন ই লাগছিল যখন মার্চ মাস চলে গেল, এপ্রিল মাস চলে গেল কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্ভোধনের কোন খবর ই নাই। সেই ক্ষোভ আবারো ভিতরে জাগতেছিল আবারো আমরা জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদ এর সহযোগীতায় মাননীয় এম,পি সেলিম উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি লোকমান চৌধুরী, আওয়ামী যুবলীগ এর প্রেসিডিয়াম সদস্য ড.আহমদ আল কবির এর সাথে দেখা করি,কিন্তু কোন লাভ হলো না। এর মধ্যে চলে আসলেন আমাদের নতুন অধ্যক্ষ স্যার এএসম শাব্বীর আহমেদ। উনি আসার পরপর ই কলেজ বদলে যেতে শুরু হলো আর উনি আমাদের প্রতিশ্রুতি দেন ডিগ্রি হবেই হবে আর ঠিক ই গত নভেম্বর ৮ তারিখ আনুষ্ঠানিক ভাবে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজে ডিগ্রি ঘোষিত হল। খুবি ভাল লাগছে আমরা সফল।

অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদকে। আন্দোলনে সব ধরনের ব্যায় বহন সহ যতোবার ই জকিগঞ্জ ছাত্র ঐক্য পরিষদের গাড়ি সিলেট এর উদ্দেশ্যে বের হতো ততবার ই গাড়ি ভাড়া ও নেতাকর্মীদের খানি খরচ বহণ করতো জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদ এবং জকিগঞ্জ প্রবাসী ঐক্য পরিষদের সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক ইকবাল তালুকদার ভাই । আর শেষ পর্যন্ত ছিল।আরো ধন্যবাদ জানাই প্রভাষক আল- মামুন ভাই, শ্রীকান্ত পাল, এনামুল হক মুন্না, রহমত আলী, আল হাসিব তাপাদার, হেলালী ভাইসহ সকল সাংবাদিক ভাই এবং জকিগঞ্জের যারা সব সময় আমাদের পাশে থেকেছিল তাদেরকে।

এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো,জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ছাত্র ঐক্য পরিষদ একটি নির্দলীয় সংগঠন ছিল,কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারলাম আমাদের সংগঠনটি অন্যদিকে মোড় নেওয়ার চেষ্টা করছে,আমাদের ভিতরে অভ্যন্তরীণ কুন্দল শুরু হয়ে গেছিল। আমি আমার নিজ হাতে গড়া সংগঠন আমার হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে ও আমি কিছু করতে পারছি না দেখে বের হয়ে আসার চেষ্টা করি কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ কুন্দল এর জন্য কলেজে কোন বদনাম হয় এবং ডিগ্রি করণে যদি কোন ব্যাঘাত গঠে সেই কথা ভেবে আমরা যারা জ.স.ক ছাত্র ঐক্য পরিষদ থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা ছিল তারা মিলে চিরবঞ্চিত জকিগঞ্জ এর দাবী আদায় ও উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য গত ১৪.১০.১৭ তারিখে জকিগঞ্জ উপজেলার ৯ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা সম্মিলিত ৫১ সদস্য বিশিষ্ট ‘তারুণ্য ছাত্র ঐক্য পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন করেছি। এবং আমরা এই সংগঠন থেকে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছি।

আমাদের মূল লক্ষ্য নামকরণ নয় আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দাবী আদায় করণ। বঞ্চিত জকিগঞ্জ কে উন্নতি সাধনে সাহায্য করা। একদিন উন্নয়ন হবে নিশ্চয়।
আমাদের কলেজ নিয়ে আন্দোলনের দাবীতে শুধু ডিগ্রি কোর্স চালু করণ ছিল না সাথে অনার্স কোর্স চালুর দাবী ছিল। আশা করি,মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সু-নজর থেকে আমরা বঞ্চিত হবো না। আবারো আমরা আরেকটি খুশির খবর শুনব, জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ ডিগ্রি কোর্স এর সাথে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে।
ধন্যবাদ।

লেখক: শিক্ষার্থী জকিগঞ্জ সরকারী কলেজ।

 

বি:দ্র: উপরোক্ত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত। লেখার কোন দায়ভার জকিগঞ্জ টুডে টোয়েন্টিফোর ডট কমের নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর