সুনামগঞ্জ জেলা সমবায় কর্মকর্তার ঘুষ-দুর্নীতির কারণে এবার দিশেহারা হয়ে পড়েছেন হাওরপাড়ের কৃষকরা। মৎস সমিতি নবায়ন, নতুন রেজিস্ট্রেশন টাকা ছাড়া হচ্ছে না। টেন্ডারের সময় পেরিয়ে গেলেও চাহিদা মতো ঘুষ দিয়ে সমিতির অনুমতি না পেয়ে অনেক এলাকার মৎসজীবিরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। তার ব্যাপারে উর্ধ্বতনদের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে জকিগঞ্জে দায়িত্বপালনকালীন ঘুষের টাকাসহ র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। পরে বালাগঞ্জেও তিনি জন্ম দেন নানা কাহিনীর। এখন সুনামগঞ্জেও এসেও তিনি ধরে রেখেছেন তার সেই ধারাবাহিকতা।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ‘গাছের জোয়ার জলমহাল’ এর তীরবর্তী গ্রাম বিষ্ণুপুরের ৬৭ জন বাসিন্দা ‘বিষ্ণুপুর মৎস সমাবায় সমিতি লি.’-এর পুরাতন কমিটি ভেঙ্গে নতুন কমিটি গঠনের জন্য ৭ জনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে আবেদন করেন। তাদের আবেদনের পর সুনামগঞ্জ জেলার ভারপ্রাপ্ত সমবায় কর্মকর্তা তার অফিসের ইন্সপেক্টর হিরন্ময় দাসকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর আবেদনকারীরা যোগাযোগ শুরু করেন সুনামগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সমবায় অফিসার-ডিসিও মো. সাদেক মিয়ার সঙ্গে। প্রথম তদন্ত চলাকালেই মো. সাদেক মিয়া আবেদনকারী বিষ্ণুপুর গ্রামের দিলীপ দাসের কাছে ঘুষ দাবি করেন। তার দাবি মতো ডিসিও সাদেকের অফিসের গিয়েই এক লাখ টাকা দেন।
ওদিকে- হিরন্ময় দাসের তদন্তের পর গ্রামবাসীর পক্ষে ৬৭ জনের আবেদন ৪৯ ধারায় জমা দেওয়া হয়নি বলে দাবি করে আবেদনটি বাতিল করা হয়। ফলে গ্রামের ৬৭ জনের পক্ষে দিলীপ দাস ফের আবেদন করেন। ওই আবেদনের দায়িত্ব দেওয়া হয় শাল্লা উপজেলার সমাবায় কর্মকর্তা আলমগীর কবির খানকে। আলমগীর কবির খান প্রথম দফা তদন্ত করার পর সেটিও লোক অনুপস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে বাতিল করা হয়।
পরে ডিসিও নতুন করে তদন্তের মৌখিক নির্দেশ দিলে উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা একদিকে ৭ জন ও অপরদিকে ৬৭ জনের পক্ষে অধিকাংশ সদস্যর বক্তব্য রেকর্ড করেন। ওই তদন্ত চলাকালে ডিসিও সাদেক মিয়াকে আরও লাখ টাকা ঘুষ দেন দিলীপ দাস।
সুনামগঞ্জ শহরের একটি চায়ের দোকানে বসে সাদেক মিয়া ওই টাকা ঘুষ নেন বলে দাবি করেন দিলীপ দাস। পরবর্তীতে ২০ সেপ্টেম্বর শাল্লা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা আলমগীর কবির খান ডিসিওর কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন।
ওই রিপোর্টে তিনি সুপারিশ করেন- বিষ্ণুপুর গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ কারনে জলমহালের নিকটবর্তী হওয়ার কারনে দিলীপ দাসকে সভাপতি, বিনোদ দাসকে সদস্য ও রাকেশ দাসকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। ওই রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর ডিসিও সাদেক মিয়া কেবলমাত্র পরিদর্শন প্রতিবেদনের উল্লেখ থাকায় তিনি সেটি গ্রহণ না করে তদন্ত রিপোর্ট দাখিলের কথা উল্লেখ করে সেটি ফিরিয়ে দেন।
পরবর্তীতে আলমগীর কবির খান তদন্ত রিপোর্ট উল্লেখ করে রিপোর্ট জমা দেন। এদিকে- ওই রিপোর্ট জমার আগে দিলীপ সহ গ্রামের ৬৭ জনের পক্ষের কাছে আরও ১ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে বলেন- দ্রুত টাকা না দিলে তিনি নতুন সমিতির অনুমোদন দিতে পারবেন না। তার এই কথায় গেলো সপ্তাহে তড়িঘড়ি করে ডিসিও সাদেকের কাছে এক লাখ টাকা প্রদান করা হয়। আর ওই টাকা গ্রহনের পর সাদেক মিয়া তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে যান।
জেলা সমাবায় অফিস সূত্র জানিয়েছে- নিয়ম হলো তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ডিসিও নতুন কমিটি গঠনের আদেশ জারি করবেন। আর নতুন কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে জলমহালে এলাকার বেশিরভাগ সদস্যের ন্যায্য অধিকার ফিরে আসবে।
দিলীপ দাস সহ বিষ্ণপুর গ্রামের লোকজন দাবি করেছেন- ডিসিও সাদেক মিয়া তদন্ত প্রতিবেদনের নামে দুই পক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। আর এখন সেটির অনুমোদন নিয়ে তিনি টালবাহানা করছেন। ওদিকে- এখন পর্যন্ত নতুন কমিটি গঠনের বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় টেন্ডারে অংশ নেওয়া বিষœপুরের প্রকৃত মৎস্যজীবিরা বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে করে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ঘাটতি থেকে বঞ্চিত হবে।
সুনামগঞ্জ জেলা সমবায় কর্মকর্তা- ডিসিও সাদেক মিয়া শুধুমাত্র গাছের জোয়ার জলমহালই নয়, আরও কয়েকটি জলমহাল নিয়ে তিনি একই ভাবে টাকার খেলায় মেতে উঠেছেন। তিনি ঘুষ দুর্নীতির কারণে গত ওয়ান ইলেভেনের সময় সিলেটের জকিগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ঘুষের টাকা সহ র্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে হেলাল আহমদ নামের এক ব্যক্তি মামলার প্রেক্ষিতে তিনি সাসপেন্ড হয়ে ৬ মাস কারাগারে ছিলেন।
পরবর্তীতে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বছর পর চাকুরীতে বহাল হয়ে বালাগঞ্জে চলে যান। সেখানেও জলমহালের ইজারা নিয়ে তিনি নানা কাহিনীর জন্ম দেন। এমনকি একটি জলমহালের তদন্ত রিপোর্টকে কেন্দ্র করে সহকারী পরিদর্শককে আতাউর রহমানের উপর সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা চালান। এ নিয়ে বালাগঞ্জে তাকে নিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সুনামগঞ্জে বদলি করা হয়।
তিনি বর্তমানে সুনামগঞ্জের সহকারী উপ নিবন্ধক পদে আছেন। কিন্তু জেলায় সমবায় কর্মকর্তার পোস্টিং না থাকায় তিনি ভারপ্রাপ্ত সমবায় কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। জলমহালের এলাকা সুনামগঞ্জ। হাওরের মানুষদের ঘুরে দাড়ানোর পর এখন জলমহালই একমাত্র ভরসা। এ কারণে বর্তমান সময়ে জলমহালের ইজারা নিতে প্রতিটি এলাকায় কমিটি গঠন ও নবায়নের তোড়জোর পড়েছে। আর বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে জেলা সমাবায় অফিস।
আর ভারপ্রাপ্ত জেলা সমবায় কর্মকর্তা সাদেক মিয়া হওয়ার কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হাওরবাসী নতুন করে দুদর্শায় পড়তে যাচ্ছেন।
কর্মকর্তা সাদেক মিয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছেন- তিনি কারও কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেননি। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে দাবি করেন তিনি।
সূত্র: সিলেটভিউ২৪ডটকম।
Leave a Reply