স্কুল নির্মাণে অনিয়ম: বদলি হয়েও এলজিইডির উপ প্রকৌশলী তাজুল জকিগঞ্জ ছাড়ছেন না

স্কুল নির্মাণে অনিয়ম: বদলি হয়েও এলজিইডির উপ প্রকৌশলী তাজুল জকিগঞ্জ ছাড়ছেন না

আল হাছিব তাপাদার, জকিগঞ্জ টুডে:: সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামকে জকিগঞ্জ থেকে বদলি করা হলেও রহস্যজনকভাবে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করছেন না। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ তাঁর অনিয়ম দুর্নীতির জন্য কৈফিয়ত তলব করে জানতে চেয়েছেন কেন বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবেনা তার বিরুদ্ধে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। তদন্তকারী কমিটির কাছে বিদ্যালয় নির্মাণে অনিয়মের ঘটনাটি প্রমাণিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে বড়লেখা উপজেলায় বদলি করেন। কিন্তু তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করে জকিগঞ্জে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। বদলী ঠেকাতে নানাভাবে চেষ্ঠা তদবিরও চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানাগেছে। উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম এরআগেও নানা অভিযোগে কুলাউড়া উপজেলায় বদলী হন। তখনও বদলি ঠেকানোর পায়তারা চালান। কিন্তু সে সময় বদলি ঠেকাতে না পেরে বাধ্য হয়ে কুলাউড়া এলজিইডি অফিসে যোগদান করেন। কিন্তু জকিগঞ্জের কর্মস্থলের প্রতি তাঁর লালসের কমতি ছিলো না। কুলাউড়ার কর্মস্থলে যোগদানের মাত্র দুই মাসের মধ্যে চেষ্ঠা তদবির করে আবারও চলে আসেন জকিগঞ্জ এলজিইডি অফিসে। এরপর আবারও জড়িয়ে পড়েন দুর্নীতিতে। সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে তদন্ত হয়। তদন্তের পর দুর্নীতি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পর আবারও তাঁর বদলীর অফিস আদেশ এসে গেছে। তবে অনিয়ম দুর্নীতির দায়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোন ব্যবস্থা এখনো নেয়া হয়নি। এ নিয়ে অনেকটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এবারও বদলি ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন তাজুল। রহস্যজনক কারণে জকিগঞ্জ ছাড়ছেন না তিনি। যেকোন ভাবেই জকিগঞ্জের কর্মস্থলে তিনি বহাল থাকতে চান।

সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ২০০৮ সালে জকিগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি অফিসে যোগদান করেছিলেন উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম। যোগদানের পর থেকে জড়িয়ে পড়েন অনিয়ম দুর্নীতিতে। ব্রীজ, কালভাট, রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজসে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুপাট করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় পাঁচ বছরের মাথায় ২০১২ সালে তাঁকে সিলেট সদর উপজেলায় বদলি করা হয়। এরপর ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি আবারও জকিগঞ্জ আসেন। আবারও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠে একাধিক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছর দুই মাসের মাথায় ২০২১ সালের জুলাই মাসে তাঁকে কুলাউড়া উপজেলায় বদলি করা হয়। কিন্তু নতুন কর্মস্থলে যোগদান করার পর থেকে জকিগঞ্জে আবারও ফিরে আসতে চেষ্ঠা তদবির শুরু করেন তাজুল। শেষ পর্যন্ত দুই মাসের মধ্যে আবারও ঘুরেফিরে জকিগঞ্জে চলে আসেন। ২০২১ সালে জকিগঞ্জ চলে আসার পর শুরু হয় ‘চাহিদাভিত্তিক সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) কাজ’। উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম ভাগিয়ে নেন সুলতানপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ কাজের তদারকি। এরপর ঠিকাদারের সঙ্গে আতাঁত করে বিদ্যালয় ভবনের পাইল নির্মাণে বড় ধরণের দুর্নীতি করে বসেন। ঝুঁকির মধ্যে পড়ে পুরো নির্মাণ কাজ। এ ঘটনায় সুলতানপুর গ্রামের নাজমুল ইসলাম শিশির নামের এক ব্যক্তি উপ প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে নির্মাণকাজের অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ দেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এলজিইডির উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি। তদন্ত শেষে ঐ বছরের মার্চ মাসে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী আলী হোসেন চৌধুরী ২৬৮ নং স্মারকে সুলতানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজে অনিয়ম দুর্নীতির জন্য উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের কাছে কৈফিয়ত তলব করেন। সেই স্মারকে সিলেট অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, বিদ্যালয় নির্মাণ কাজের জন্য সদর দপ্তর হতে অনুমোদিত ড্রয়িং অনুযায়ী ভবনের বেইসের নিচে ৩৭টি ১৪”ঢ১৪” সাইজের ৭১.৬৮৭ ফুট দৈর্ঘ্যরে প্রি-কাষ্ট পাইল ধরা আছে। প্রি-কাষ্ট পাইল দুটি অংশে ৪১.৬৭ ফুট ও ৩০ ঢালাই করে ড্রাইভিং করা কথা। অথচ উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম পাইলের একটি অংশ নির্মাণ ও ডাইভ করে পাইল ক্যাপ ঢালাই কাজ সম্পন্ন করেছেন। ডিজাইন অমান্য করে কম দৈর্ঘ্যরে পাইল কাজ করায় পুরো নির্মাণ কাজ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তদারকী কর্মকর্তা উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম অনুমোদিত ড্রয়িং ডিজাইন অনুসরণ না করে ঠিকাদারের সাথে যোগসাজস করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে এহেন অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন মর্মে প্রতিয়মান হয়। যা সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতি পরায়নতার সামিল ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমতাবস্থায় কেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হবেনা মর্মে জবাব চান। কিন্তু এ চিঠি পেয়ে উপ সহকারী তাজুল ইসলাম বিভিন্নভাবে তদবির করে বিভাগীয় শাস্তি থেকে পার পেয়ে যান। এরপর গত অক্টোবর মাসে আবারও একই ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ মহসিন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশ আসে। সেই আদেশে উল্লেখ করা হয় উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনাটি সরেজমিন তদন্ত করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। কিন্তু সেই কমিটি কোন প্রতিবেদন দাখিল করেননি। এ কারণে নতুন করে আবারও এলজিইডি সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাসকে আহবায়ক করে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। এরমধ্যে গত ২০ ডিসেম্বর এলজিইডি সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রকাশ চন্দ্র বিশ্বাস স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে আবারও উপ সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামকে জকিগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে বড়লেখা উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে বদলী করেন। কিন্তু এবারও বদলী আদেশ ঠেকাতে তৎপর হয়ে ওঠেছেন তাজুল। জকিগঞ্জের কর্মস্থলে বহাল তবিয়তে থাকার খায়েশে নিচ্ছেন না ছাড়পত্র। তাঁর পক্ষে অসাধু কয়েকজন ঠিকাদারও তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ভিডিও দেখুন এই লিংকে ‘জকিগঞ্জ আই টিভি’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঠিকাদার জানান, উপ প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের বড় ধরনের দুর্নীতিবাজ। সরকারী বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডে অনিয়ম করে সরকারের সিংহভাগ অর্থ তছরুপ করেছেন। আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়কে ৩ কোটি ৪১ লাখ টাকার কাজ সমাপ্ত ছাড়াই ঠিকাদারকে পুরো কাজের বিল দিয়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু সড়কটির অনেক জায়গায় এখনো কাজ হয়নি। ভাঙ্গা সড়কে যানবাহন চলাচলে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। যতটুকু কাজ হয়েছে তাও নিম্নমানের। ঠিকাদার বিল নিয়ে কাজ বন্ধ করে চলে গেছে। আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক সংস্কার কাজের টাকাও ঠিকাদারের সঙ্গে ভাগভাটোয়ারা করে লুপাট করা হয়েছে। তাজুল ইসলামের তত্ত্ববধানে হওয়া কাজগুলোতে উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্ত করলে ব্যাপক দুর্নীতির প্রমাণ বেরিয়ে আসবে। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অনেক প্রমাণ থাকার পরও রহস্যজনকভাবে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়না।

অভিযোগ প্রসঙ্গে উপ-সহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেগে গিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, জকিগঞ্জ থেকে ছাড়পত্র নিচ্ছিনা কেন তা ব্যাখা দেয়া লাগবে কি? আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়কের কাজের পুরো দিয়ে দিয়েছেন স্বীকার করে বলেন, কোথায় বাকি রয়েছে তা জানা নেই। সুলতানপুর স্কুলের অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন শুনে অফিসে যাবার কথা বলে ফোন কল কেটে দেন।

এ নিয়ে জকিগঞ্জ উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী রাশেদুর রহমানের ব্যক্তিগত ও সরকারী মোবাইল ফোনে বার বার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

সিলেট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ইনামুল কবিরের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিচয় শুনে মিটিংয়ে আছেন বলে কল কেটে দেন। পরে একাধিক বার কল দিলেও আর কল রিসিভ করেন নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর