সাংবাদিক নয় ‘সামবাদি’, এক লাইন লেখতে কলম ভাঙে!

‘হঠাৎ করে এলো যে এক সাংবাদিক, কথায় কথায় তোলে ছবি ভাবখানা তার সাংঘাতিক। তিলকে সে বানায় তাল-তালকে আবার তিল, চড়ুইকে সে পেঁচা বানায় কাককে বানায় চিল। সবাই বলে লোকটা নাকি আজব এক সাংবাদিক।’

পেশাদার সম্মানিত সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি লজ্জাকর হলেও ছড়া ছন্দের মতই ভূয়া সাংবাদিকরা দেশ জুড়ে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলেছে। সারা দেশে ‘ভুয়া মানবাধিকার কর্মী আর ভূয়া সাংবাদিক’দের দৌরাত্ম্য অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে চরমে পৌঁছেছে। ভূয়া সাংবাদিক আর কথিত মানবাধিকার কর্মিদের নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর বর্তমানে ফেসবুক খোললেত কোন কথাই নেই সাংবাদিক আর মানবাধিকার নেতার অভাব নেই। ডিজিটাল যুগে ফেসবুক হয়ে গেছে সাংবাদিক বনার হাতিয়ার।

সাংবাদিকদের মতো বেশভূষায় সেজেগুজে একশ্রেণীর প্রতারক অলিগলি, হাট-বাজার চষে বেড়াচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলেই রীতিমত বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ছেন সেখানে। প্রকৃত ঘটনা কি-সে ঘটনার আদৌ কোনো নিউজ ভ্যাল্যু আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার ফুসরৎ তাদের নেই। তাদের দরকার নিজেকে সাংবাদিক প্রমাণ করা। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ বাসিন্দারা পর্যন্ত কথিত সাংবাদিক কার্ডধারী ভূয়াদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন, তটস্থ থাকছেন। পেটে বোমা ফাটালেও দু’ লাইন লেখার যোগ্যতাহীন টাউট বাটপারের দল সাংবাদিকতার লেবাস পরতে সিদ্ধহস্ত। লেখতে গেলে কলম ভাঙ্গে। শব্দে শব্দে থাকে বানান ভূল। সাংবাদিকতা পেশা সমন্ধে নূন্যতম জ্ঞানও নেই তাদের। কোনটা সংবাদ আর কোনটা সংবাদ নয় জানেনা সেটাও। এরপরও তারা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বসে।

সম্প্রতি সময়ে সিলেটে এক ভূয়া সাংবাদি যে কাণ্ড ঘটিয়ে তাতে পেশাদার সাংবাদিকরা বেশী লজ্জিত। কিন্তু বেহায়ারা মোটেও বিচলিত নয়। আসলে ভূয়া সাংবাদিকের দৌরাত্ম্য দেশে নতুন নয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকের কারণে তা বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। আপনার আমার আশপাশেও ভূয়া সাংবাদিকের প্রজনন মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে পেশাদার সাংবাদিকরা আজ নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন।

সাংবাদিকতার যে মহান পেশা সকল শ্রেণী-পর্যায়ের ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম, বিভ্রান্তি, অসঙ্গতির বিস্তারিত তুলে ধরে, এখন সে পেশার নাম ভাঙ্গিয়েই চলছে ভয়ঙ্কর ফাঁকিবাজীর কারবার। কারা অপকর্মটি করছেন? অনেকেরই তা জানা আছে। সাংবাদিক না হয়েও সাংবাদিকতার বেশভূষা তাদের মূল পুঁজি। অখ্যাত একাধিক গণমাধ্যমের ৪/৫টি আইডি কার্ড বুকে পিঠে ঝুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় সর্বত্র। যারা পেশাদার সাংবাদিক তাদের কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সাইনবোর্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন তারা। সম্ভব হলে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে নিজের নামটা লিখিয়ে নেয়, তা না হলে নিজেরাই ‘সাংবাদিক’ ‘রিপোর্টার’ ‘প্রেসক্লাব’ শব্দ যোগ করে ভূইফোঁড় কোনো সংগঠন খুলে বসে। পেশাজীবী সংগঠন গড়তে, বৈধতা পেতে যেহেতু আলাদা কোনো নিয়ম কানুনের দরকার পড়ে না; সেই সুযোগে আলু পটলের ব্যবসায়ী থেকে নিয়ে ড্রাইভার, সিকিউরিটি গার্ড ব্যবসায়ী, কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ নরসুন্দর, দারোয়ান, পান বিক্রেতাসহ স্বশিক্ষিতরা পর্যন্ত এ পেশার লেবাস পরেছে। এই প্রতারক চক্রের একটি বড় অংশ বিভিন্ন অখ্যাত আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ডধারী সাংবাদিক। এইসব ভুয়া সাংবাদিকদের ঠাটবাট এমন যে তাদের সাধারণ মানুষ সহজে ধরতে পারেন না আসল-নকল। ভূয়া সাংবাকিরা হাটতে বসতে শুধু তেলবাজি আর আর ভেল্কিবাজীই করেই নিত্য কারবার সারে। ফেসবুকে কখন কি লেখে সাংবাদিকতার ভাব প্রকাশ করবে তা বুঝা দায়। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মাঝেমধ্যে পেশাদার সাংবাদিকরাও বিভ্রান্ত হন৷

দেখা গেছে, সাংবাদিক পরিচয়ধারী এসব প্রতারক চক্র শুধু নামসর্বস্ব পত্রিকার আইডি কার্ড বহনই নয়, বিভিন্ন ঘটনাস্থলে গিয়ে তারা মূল ধারার বড় পত্রিকার সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক পরিচয় দেয়। তাদের ভাব ভঙ্গির কারণে সাধারণ মানুষ বার বারই বিভ্রান্ত হন। বর্তমান সময়ে অনেকের ধারণা আলু পটলের ব্যবসায়ী থেকে নিয়ে ড্রাইভার, সিকিউরিটি গার্ড ব্যবসায়ী, কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভ নরসুন্দর, দারোয়ান, পান বিক্রেতাসহ স্বশিক্ষিতরা পর্যন্ত এ পেশার পরিচয়পত্র কিভাবে পায়? সেই প্রশ্নের উত্তর হলো, সারাদেশে অসংখ্যা ভূইফোঁড় পত্রিকা রয়েছে। ভূইফোঁড় পত্রিকার হর্তাকর্তারা ২/৩ হাজার টাকায় সাংবাদিক পরিচয়পত্র বিক্রি করে থাকে। তাদের কাছ থেকে টাকা দিয়ে একশ্রেণীর লোকজন টাউট বাটফাররা কার্ড কিনে এনে সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিংবা ৪/৫ হাজার টাকা দিয়ে আজব নামে একটি পোর্টাল খোলে নিজেকে সম্পাদকই বানিয়ে ফেলে। নিয়োগ দেন সাংবাদিক। অথচ সংবাদ কাকে বলে তাও বুঝেন না। রীতিমত কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপও ব্যবহার জানেনা!

আমার মত অনেক পেশাদার সাংবাদিকরা মনে করেন যে, ভূয়া সাংবাদিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে কতিপয় অসৎ পুলিশের অনেকটা ভুমিকা রয়েছে। কারণ, অসৎ পুলিশের সঙ্গেই ওইসব ভূয়া ও নামধারী সাংবাদিকদের বেশি সখ্যতা। এরা প্রায়ই রাতে পুলিশের সোর্স হলে ভোরের আলো ফোটার পরপরই সাংবাদিক হয়ে যায়। তবে পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও তারা কিন্ত বিশ্বস্থ!

তাছাড়াও অলিতে গলিতে গজিয়ে উঠেছে নাম সর্বস্ব ভূয়া মানবাধিকার সংগঠন। যার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সারা দেশব্যাপী চলছে তাদের কার্ড বাণিজ্য। এই ভূয়া মানবাধিকার সংগঠনের কারনে মানবাধিকার শব্দটি আজ আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কারনে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ মানবাধিকার এর উপর থেকে তাদের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। যাদের মানবাধিকার সম্বন্ধে নূন্যতম জ্ঞানও নেই তাদের হাতে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে মানবাধিকার কর্মীর আইডি কার্ড। তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে থানা কমিটি এবং ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে জেলা কমিটি গঠনের অনুমোদনও দেয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্গের ছাতার মতো সারা দেশে খুলে বসেছে শাখা প্রশাখা, এমনও অনেক সংগঠন আছে যারা সরকারের কোন সংস্থারই অনুমোদন না নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু মাত্র প্রেস লেখা আইডি কার্ড কেনাবেচাই যাদের মূল পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার নামক সংস্থায় কাজ করে মুরগী আর পান ব্যবসায়ী, পেশাদার অপরাধীরা নামের আগে পিছে বসাচ্ছে সাংবাদিক। নিজের নাম লিখতে কলম ভাঙ্গে, সাংবাদিক বলতে গেলে উচ্চারণ করে বসে সামবাদিক, নিজের সংগঠনটির নাম পর্যন্ত বলতে পারে না-তারাই রাতারাতি মানবাধিকার-সাংবাদিক সংগঠনের নেতা বনে গেছেন। কী সেলুকাস !! কত বৈচিত্র্য আর বিচ্যুতিতে ভরা প্রিয় বাংলাদেশ !!!

সাংবাদিক পেশার ক্রান্তিলগ্নে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম এবং মূলধারার সাংবাদিক সমাজকে ভুয়া সাংবাদিক চিহ্নিত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। নয়তো সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে আর পেশাদার সাংবাদিকরা দিনদিন আরও বেশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে। এখনই পদক্ষেপ নিন। মেধাবী-শিক্ষিতদের এ পেশায় আনুন। জাতির আয়না খ্যাত এ পেশাকে টিকিয়ে রাখুন। এতে দেশের ও দশের মঙ্গল হবে।

 

লেখক: আল হাছিব তাপাদার
জকিগঞ্জ প্রতিনিধি: দৈনিক যুগান্তর।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর