মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী হচ্ছেন সুচি

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, মিয়ানমারে নিপীড়ন থেকে রক্ষায় রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড়ানোয় আউং সান সুচি মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। শুক্রবার যুক্তরাজ্যের সম্প্রচার মাধ্যম চ্যানেল ফোরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন ইয়াংহি লি।

মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা লির মতে, অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা বা তা রোধে কিছু না করার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যা হয়েছে, তা কোন জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে নিপীড়ন চালানো- একথার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন তিনি।

সেখানে কি রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিধনের চেষ্টায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কী না সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একদম। গণহত্যা নিরূপণে আইনীভাবে নির্ভুল হতে হবে এবং এটা একটা আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হতে হবে। তাই আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, সেখানে গণহত্যার বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

রাখাইনে যে কয়জন রোহিঙ্গা নিহতের খবর প্রকাশ হয়েছে তার চেয়ে এই সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন ইয়াংহি লি। সেখানে আরও গণকবর পাওয়া যাবে তা তাড়াতাড়ি বা পরে হোক না কেন। কারণ সেখানে এরকম কিছু ঘটেছে বলে আমার কাছে খবর এসেছে।

বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ওপর সমীক্ষার ভিত্তিতে

আন্তর্জাতিক চিকিৎসাবিষয়ক দাতব্য সংস্থা মিতসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ে (এমএসএফ) বলেছে, মিয়ানমারে ২৫ আগস্ট সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর একমাসেই অন্তত ৬ হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।

এ বিষয়ে সুচির অবস্থান নিয়ে তার মনোভাব জানতে চাইলে লি বলেন, হয় তিনি বিষয়টি অস্বীকার করছেন অথবা প্রকৃত ঘটনা থেকে তিনি অনেক দূরে আছেন। সাক্ষাৎকারগ্রহীতা মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী আউং সান সুচিকে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দেবী’ অভিহিত করলে জাতিসংঘের বিশেষ দূত লি বলেন, তিনি কখনই মানবাধিকারের দেবী ছিলেন না। তিনি একজন রাজনীতিক ছিলেন এবং এখনও তিনি একজন রাজনীতিক।

সুচির বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হবে কী না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতাও জবাবদিহির আওতায় থাকে। ইয়াংহি লি ২০১৪ সালে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ছয়বার মিয়ানমার সফর করেছেন। তবে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা বলে মিয়ানমার তাকে সব সময় অবাধে কাজ করার সুযোগ দেয়নি। তিনি সর্বশেষ মিয়ানমারে গিয়েছিলেন গত জুলাইয়ে। এরপরই রাখাইনে সহিংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা পালাতে শুরু করলে মিয়ানমারে তার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটির সরকার। চলতি বছর জানুয়ারিতে ইয়াংহি লি বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সফর করেন।

এ বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে লি বলেন, তারা বলে, আমি ন্যায়নিষ্ঠ নই এবং পক্ষপাতিত্ব করি। প্রতিবার আমি জিজ্ঞেস করেছি, কোন বিষয়ে আমি পক্ষপাতিত্ব ও অন্যায্য কিছু করেছি বা বলেছি, তার কোন স্পষ্ট জবাব আসেনি। যখন আমি বলেছি, রোহিঙ্গাদের এটা-ওটা, তখন মিয়ানমার সরকার বলেছে, ‘আমাদের কোন রোহিঙ্গা নেই’। আমি নীতিগতভাবে এটা মেনে নিতে পারিনি। তাই কি পক্ষপাতিত্ব?

তিনি বলেন, যখন আমি বলেছি, সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও নিবর্তনমূলক গ্রেফতার বা ধর্ষণ হয়েছে, তারা (মিয়ানমার সরকার) তখন বলে, ‘না, আমরা কখনও এটা করিনি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন হবে না বলে মনে করেন জাতিসংঘের দূত লি।

ইয়াংহি লি বলেন, আমি বলছি যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যেসব বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক আইন আছে সেগুলো বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আপনারা আবারও একই ঘটনা ঘটতে দেখবেন। এমনকি, তারা ফিরে যাওয়ার পর। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার বছরের পর বছর মুসলিম রোহিঙ্গাদের ‘কানা গলিতে গবাদি চরানোর’ মতো আচরণ করছে বলে মনে করেন ইয়াংহি লি। তিনি বলেন, বাস্তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এটাই হচ্ছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে তাদের খুব ক্ষুদ্র এলাকায় বিচরণ করতে হয়।

এর আগে গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি এবং দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং লাইংসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মালয়েশিয়ার একটি আন্তর্জাতিক গণআদালত। কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল’-এর আট সদস্যের বিচারক প্যানেল ওই রায় দেন।

মালয় ইউনিভার্সিটিতে পাঁচ দিন ওই গণ আদালতের শুনানি চলে। বিচার শেষে আদালত জানায় মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। গণআদালতের ওই রায় জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গোষ্ঠীর কাছেও পাঠানো হয়েছে।

গণআদালতের শুনানিতে রোহিঙ্গা ও কাচিন সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় অপরাধের বর্ণনা দেন। আদালতে আমেরিকার জর্জ মাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্ট্যাডিজ এ্যান্ড প্রিভেনশনের গবেষক অধ্যাপক গ্রেগরি স্ট্যানটন জবানবন্দী দিয়েছিলেন। শুনানিতে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। ট্রাইব্যুনালে মিয়ানমারে মুসলিম নিপীড়ন বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়। পরে আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন সুচি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

সূত্র: জনকন্ঠ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর