স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দান করা জমিতে গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা। স্থানীয় শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শিক্ষক হিসেবে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে সামান্য টাকা টিউশন ফি হিসেবে আদায় হয় তা দিয়ে কোনমতে চালানো প্রতিষ্ঠানের আনুসঙ্গিক ব্যয়ভার। কিন্তু শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আর হয় না। যদিও বা কোথাও হয়, তার পরিমাণ নিতান্তই যত্সামান্য। তবু তারা শিক্ষাদান চালিয়ে যান এই ভরসায় যে, একদিন প্রতিষ্ঠানটি সরকারের নেক নজরে যাবে, এমপিওভুক্ত হবে। তাদের বেতন-ভাতার অনিশ্চয়তা দূর হবে। কিন্তু বছরের পর বছর চলে যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এক যুগ, দেড় যুগ বা দুই যুগও চলে যায়। প্রতিষ্ঠান আর এমপিওভুক্ত হয় না। প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ ও যোগ্যতা থাকা সত্বেও সারা দেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা কমপক্ষে ৭ বছর ধরে এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। একই ভাবে ঝুলে আছে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৭৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার ভাগ্য। এমনও আছে, এমপিওভুক্তির আশায় থাকতে থাকতে বয়সের কারণে অনেক শিক্ষক ইতিমধ্যে এই পেশাই ছেড়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০১০ সালে সরকার এক হাজার ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। প্রায় একই সময় এমপিও পায়নি অথচ পাওয়ার যোগ্য এমন পাঁচ হাজার ২৪০টি স্কুল সরকারের তরফ থেকেই চিহ্নিত করা হয়। এসব স্কুলে শিক্ষক ৭৫ হাজার। এই সাত বছরে আরো কয়েকশ’ প্রতিষ্ঠান এমপিও পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এমপিওভুক্ত করতে না পারার কারণ হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানিয়েছেন অর্থ সংকটের কথা।
তবে শিক্ষক সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে এমপিওবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ৮ হাজার। আর শিক্ষক ১ লাখ ২০ হাজার। কিন্তু আর্থিক সুবিধা না পাওয়ায় গত সাত বছরে ২ হাজারের মতো স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।
নন-এমপিও শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি এশারাত আলী বলেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করা দরকার তার সবই পূরণ হয়েছে ৫ হাজার ২৪২টি প্রতিষ্ঠানের। এগুলোর মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় পার করা অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৭৫ হাজারের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী চরম হতাশায় ভুগছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা করছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, এমপিভুক্তির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা এমপিওভুক্তির যোগ্য। অর্থ সংকটের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি।
মন্ত্রী বলেন, যেহেতু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেবে অর্থমন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কেই বলেছি এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির জন্য। তারা এমন উদ্যোগও নিয়েছেন, কমিটিও গঠন করা হয়েছে। নীতিমাল হবার পরই বোঝা যাবে কোন কোন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করছে।
নতুন এমপিওভুক্তির জন্য তালিকা তৈরি যাচাই বাছাই চলছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির যোগ্য রয়েছে। সে হিসাব আমাদের কাছে রয়েছে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেন, এমপিওভুক্তির দাবির বিষয়ে একটি সমাধান দরকার। এভাবে চলতে পারে না।
তথ্যমতে, ২০১০ সালে সবশেষ এক হাজার ৬২৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে সরকার। এর আগে এমপিওভুক্তির কার্যক্রম বন্ধ ছিল ছয় বছর। ২০১৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের সময় শর্তজুড়ে দেওয়া হচ্ছে যে, এমপিও সুবিধা দাবি করা যাবে না। ২০১১ সালে ১০০০ বিদ্যালয় ও মাদরাসা এমপিওভুক্তি করার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা করা হয়নি। তবে ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশ করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।
এমপিওভুক্তির নীতিমালা করেও বিগত সরকারগুলো নীতিমালা মানেনি। দেশে ২৭ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত । জনসংখ্যা বিবেচনা এ সংখ্যা কম নয়। তবে কোথাও কোথাও প্রয়োজনের বেশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। আবার প্রয়োজন থাকলেও সিলেট বিভাগে কম স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। কম এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বরিশাল ও খুলনা বিভাগেও।
পরিকল্পনায় আছে বরাদ্দ নেই : চলতি অর্থবছরের পরিকল্পনার মধ্যে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি’র কথা থাকলেও বাজেটে কোনো বরাদ্দ নেই। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ রাখা যায়নি।
শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয় ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। শিক্ষায় চলতি বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় এক হাজার ৪২২ কোটি টাকা বেশি। গত অর্থবছরে শিক্ষা খাতে ৪৯ হাজার ১০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এত বরাদ্দ থাকার পরও নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিনা বেতনে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিতরা।
নীতিমালা না মেনে এমপিওভুক্তি : কয়েক হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো নীতিমালা না মেনে অনুমোদন দেয়া হয়। এ কারণে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও এমপিওভুক্ত হতে পারেনি অনেক জেলার প্রতিষ্ঠান। প্রায় সব সময়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় এমপিওভুক্তি দেওয়া হয়েছে। স্থান নির্বাচনের বেলায় বাস্তব প্রয়োজনের চেয়ে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। যে কারণে বিগত এক দশকে এমন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কম, কোথাও শিক্ষার্থীর সংখ্যা শিক্ষকের চেয়েও কম। অথচ অনেক জায়গায় প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষার্থীরা ভোগান্তির কবলে পড়ছে। কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় দূরের স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করতে হচ্ছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫ হাজার ৫৯০টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা না করেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আবার প্রয়োজনীয় স্থানে তিন হাজার ৭০৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সরকারের বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী অনেক আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া দরকার ছিল।
এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই বলা যায় অপ্রয়োজনীয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলও ভালো নয়। অথচ এমপিওভুক্ত হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে প্রতিমাসে সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
রাজশাহীর একটি উপজেলায় ২৭টি এমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে। যশোরের ১টি ইউনিয়নে ২টি গার্লস কলেজ রয়েছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ধরনের অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কারণে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আগে বিবেচনা আনতে হয় প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম অনুযায়ী পাঠদানের অনুমতি পেয়েছে কিনা।
এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া : নিয়ম অনুযায়ী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রথমে পাঠদানের অনুমতি নিতে হয়। তারপর একাডেমিক স্বীকৃতি এরপর শিক্ষার কার্যক্রম শুরু, শিক্ষক পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যোগ্যতা মূল্যায়নের পরই এমপিওভুক্তি করা হয়। সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তালিকা যাচাই-বাছাই করে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, এমপিওভুক্তির তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।
নীতিমালায় এমপিওভুক্তির জন্য মানদন্ড ঠিক রাখতে ১০০ নম্বর বরাদ্দ রাখা হয়। এতে একাডেমিক স্বীকৃতির জন্য ২৫, শিক্ষার্থীর জন্য ২৫, পরীক্ষার্থীর সংখ্যার জন্য ২৫ এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হারের জন্য ২৫ নম্বর রাখা হয়। এতে স্বীকৃতির সময়সীমা ২ বছর হলে ৫ নম্বর পাওয়া যাবে। যদি স্বীকৃতির সময়সীমা ১০ বছর বা তারও বেশি সময় হয় তাহলে ২৫ নম্বর পাওয়া যাবে। শিক্ষার্থীর সংখ্যায় কাম্যসংখ্যার জন্য ১৫ নম্বর দেয়া হয়। তবে কোন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কাম্যসংখ্যার পরবর্তী প্রতি ১০ শতাংশের জন্য ৫ নম্বর প্রদান করা হয়। একইভাবে পরীক্ষার্থীর এবং ফলাফলের
Leave a Reply