আল হাছিব তাপাদার, জকিগঞ্জ টুডে:: সিলেটের জকিগঞ্জে ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে গেছে। প্রায় সপ্তাহ দিন পানির নিচে থাকা জকিগঞ্জের প্রায় নয়টি ইউপির বিভিন্ন এলাকার ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ এখন স্পষ্ট হচ্ছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘর, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলি জমির পাশাপাশি এই বন্যায় মাছের ঘের ও পুকুরের বড় ক্ষতি হয়েছে। প্রায় শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নিঃস্ব হয়েছেন কৃষি ও মৎস্যখাতে বিনিয়োগকারী ছোটবড় ব্যবসায়ীরা।
উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের তথ্যমতে জানাগেছে, প্রায় এক সপ্তাহের বন্যায় উপজেলার ৫৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি ঢুকে প্রায় ৬০ লাখ টাকার ও ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় ৬ হাজার ৩৫০টি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে মৎস্যখাতে প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কৃষিখাতে ২৪৫ হেক্টর জমির আউশের বীজতলা, ২৮৫ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে কয়েক কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। গ্রামীণ ৭৯টি রাস্তা মারাত্মক বিধ্বস্ত ও একাধিক নির্মাণাধীন নতুন রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। র রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।
জকিগঞ্জ সদর ইউপির রারাই গ্রামের আবুল কালাম সিদ্দীকী উজ্জল বলেন, আমাদের গ্রামের প্রত্যেকের বাড়ির পুকুরে কম বেশী মাছ চাষ করা হয়। সর্বনিম্ন ১০/১৫ হাজার টাকার মাছ ছিলো সকল বাড়ির পুকুরে। আবার অনেকে পুকুরে লাখ লাখ টাকার মাছ চাষাবাদ করেছেন। তাছাড়াও অনেকের ফিসারীতে ছিলো অর্ধকোটি টাকার মাছ। কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে সবকিছু পানিতে তলিয়ে গেছে। একটা মাছও নেই। কৃষিখাতেও মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ও অনেকের বাড়িঘর নষ্ট হয়ে গেছে। এলাকার অনেক লোকজন নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
একই এলাকার রিপন আহমদ বলেন, গ্রামের একাধিক পুকুরে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩০/৩৫ লাখ টাকার মাছ ছিল। কিন্তু বাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে সবকিছু ভেসে যাওয়ার কারণে পুকুরে এখন মাছ নেই। ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনকে সরকারীভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহনের দাবী জানান।
ভিডিও দেখুন এই লিংকে ‘জকিগঞ্জ আই টিভি’
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কথা হয় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজনীন সুলতানার সঙ্গে। তিনি জানান, বন্যায় ১২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫টি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পানি ঢুকেছে। এতে প্রায় ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুস ছালাম জানান, ৩৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আলিয়া মাদ্রাসা ও কলেজে বন্যার পানি ঢুকেছে। ৭টি স্কুল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সবমিলিয়ে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যার পানি বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় শিক্ষার্থীদের বই-খাতা বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু তাহের চৌধুরী জানান, বন্যায় ৬ হাজার ৩৫০টি পুকুরের মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
উপজেলা প্রকৌশলী মনছুরুল আলম জানান, ৭৯টি রাস্তা মারাত্মক বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া একাধিক নির্মাণাধীন নতুন রাস্তার ক্ষতি হয়েছে। বেশির ভাগ রাস্তার ওপরের অংশ উঠে গেছে। এর মধ্যে কয়েকটি রাস্তা মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে।
উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা শেখ ফরিদ জানান, বন্যায় আউশের ২৪৫ হেক্টর জমির বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন ২৮৫ হেক্টর জমির সবজি পানিতে ডুবে গেছে। এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, বন্যার পানি নেমে যাবারও পর ক্ষতিগ্রস্থ অনেক এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানিতে পুকুর ও টিউবওয়েল ডুবে যাবার কারণে পানি নষ্ট হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে জ্বর, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ। কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষরা চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে ঘাস নষ্ট হয়ে যাবার কারণে গো-খাদ্যের চরম সংকট দেখা দেয়ায় গরু, ছাগল ও মহিষ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। পানি নেমে যাবার সাথে সাথে অনেক এলাকায় বিভিন্ন প্রজাতির সাপের উপদ্রবের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ফয়সাল জানান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে বিভিন্ন দপ্তর কাজ করছে। এখনো পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বলা যাচ্ছেনা। যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদেরকে পুনর্বাসন করতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। মৎস্য ও কৃষিখাতে যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাঁরা লিখিতভাবে প্রশাসনকে জানালে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হবে। কোন ঘরবাড়ি ভেঙে পড়েছে এমন কোন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, বানভাসী মানুষের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে ১০০ টন চালের চাহিদার বিপরীতে ৬২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। ১ লাখ টাকা ও ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।
Leave a Reply