দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক:: ওয়ান-ইলেভেনে যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং মামলায় দন্ড প্রদানের ভয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকশ’ নেতা দেশে-বিদেশে আত্মগোপন করেছিলেন। পরিবারসহ দেশ ছেড়েছিলেন তারা। দেশ ছাড়া নেতাদের বেশিরভাগ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন।
কেউ কেউ আবার দেশেই নিরাপদ জায়গায় আত্মগোপন করেছেন। এজন্য তারা নিজেদের বেশভুষাও পরিবর্তন করেছিলেন। আত্মীয়-স্বজনসহ নিকটজনদেরও জানতে পারেননি কোথায় তারা আত্মগোপন করেছিলেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা আত্মগোপন করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন- সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, ঢাকার ধানমন্ডি ও মোহাম্মাদপুর থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মকবুল হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও ফেণী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, শেখ হাসিনার নিকট আত্মীয় শেখ হেলাল, আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ আব্দুল্লাহ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বাহাউদ্দিন নাসিম, যুবলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি মির্জা আযম এবং ছাত্রলীগের সভাপতি লিয়াকত সিকদার।
বিএনপি নেতাদের মধ্যে যারা দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে গিয়েছিলেন তারা হলেন- তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল্লাহ আল নোমান, সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন, মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দার প্রমুখ। এছাড়া গ্রেফতার, নির্যাতন ও দন্ডের ভয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক নেতা দেশ এবং দেশের বাইরে আত্মগোপন করেন। যদিও তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে সাজা দেওয়া হয়েছিলো।
এছাড়া সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা মরহুম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মরহুম ফজলুর রহমান পটল, সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহম্মদ, ডেমরার সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন, লালবাগের সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, সাবেক এমপি মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, মেয়র মুজিবর রহমান সারওয়ার এবং মেয়র মিজানুর রহমান মিনুসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের পরিবারের সদস্যরা আত্মগোপন করে মানবেতর জীবন যাপন করেছেন।
দেশে আত্মগোপন করাও নিরাপদ মনে না করে যাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে তারা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপির বর্তমান স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে বিদেশ গিয়েছিলেন। তবে তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন।
তিনি জানিয়েছেন, ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আসার ৬ মাস পর তিনি দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। আবার ফিরেও এসেছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের কোন অভিযোগ ছিলো না। এমনকি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের যে তালিকা ওয়ান-ইলেভেনের সরকার প্রকাশ করেছিলো সে তালিকায় তার নাম ছিলো না।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলম পুরো পরিবারসহ, ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম, প্যাসিফিক গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ খান, বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান, প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল, মদিনা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাজী সেলিম, হামীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ, আরামিট গ্রুপের আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুসহ আরও অনেকে।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের কেউ কেউ গ্রেফতার হওয়ায় বাকিদের অনেকে ভয়ে দেশ ছেড়ে আত্মগোপন করেন। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্ণর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ব্যাংকারদের এক সভায় আটক বা পলাতক ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালু রাখতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেন।
একইদিন ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ গৃহায়ণ, পূর্ত ও তথ্য উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন তার কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেন, সরকার কোনো ব্যবসায়ীকে অকারণে আর হয়রানি করবে না।
নানান কৌশলে দেশত্যাগ : সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর তার লেখা ‘Notes from a prison:Bangladesh’ বইয়ে তার নিজের স্ত্রী, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো: নাসিম, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমানের স্ত্রীসহ তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের কি ধরণের ঝুকি নিয়ে যৌথবাহিনীর ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে তার হৃদয় বিদারক বিবরণ দিয়েছেন।
মো: নাসিমের স্ত্রীর ভারত পালিয়ে যাওয়ার বিবরণ আরও মর্মান্তিক। তাকে একটি মহল বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত পার করেন ছোট নৌকায়। ভারত বা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীর পেট্রোল যে সব ছোট শাখা নদীতে যেতে পারে না, সে রকম নদী দিয়ে বৃষ্টিভেজা রাতে মিসেস নাসিমকে নৌকার পাটাতনের নীচে লুকিয়ে সীমান্ত পার করে দেয়া হয়। এমনিভাবে নানা কৌশলে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে জরুরি আইনের সরকারের যৌথবাহিনীর ভয়ে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে পালিয়ে যেতে হয় গ্রেফতারকৃতদের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের। স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে পেরেছেন জানতে পারলে প্রত্যেক কারাবন্দি মনে করতেন তাদের মাথা থেকে বিরাট বোঝা অপসারিত হয়েছে।
মহিউদ্দিন খান আলমগীরের স্ত্রীকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা খোঁজ করছেন এবং দুর্নীত দমন কমিশন (দুদক) তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দিয়েছে ছিল। এটা জানতে পেরে তিনি স্ত্রীকে বিদেশে পালিয়ে আমেরিকার বোষ্টনে তার ছেলেদের কাছে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তার স্ত্রী প্রথমে রাজী হননি। পরে বারবার অনুরোধ করার পর তার স্ত্রী অবশেষে বিদেশ যেতে রাজী হন। তিনি জানতেন দুদক অথবা টাস্কফোর্স তার স্ত্রীর নাম এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে দিয়ে থাকতে পারে। তাই এই বাধাকে অতিক্রম করার জন্য তিনি কৌশল ঠিক করেন। তিনি তার একজন পরিচিত কুটনীতিকের সহযোগিতায় তার স্ত্রীকে বিদেশে পাঠান।
বিএনপির বর্তমান কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান ওয়ান-ইলেভেনে চিকিৎসার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন। প্রথমে তিনি তার স্ত্রীসহ সিঙ্গাপুর যান। সেখানে চিকিৎসা শেষে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। পরে সেখানেই বাসাভাড়া করে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। পরবর্তীতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসলে তিনি দেশে ফেরেন।
দেশ ছাড়ার জন্য বিমানবন্দরে গেলে সেখানে টাস্কফোর্সের সদস্যরা তাদের অবস্থান করতে বলেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বিমান ছাড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে তাদের গ্রিন সিগন্যাল দেন টাস্কফোর্সের সদস্যরা।
নোমান জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুরে হাসপাতাল চিকিৎসাধীন তৎকালীন বিএনপি মহাসচিব মরহুম অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়েছিলো। এছাড়া সিঙ্গাপুরে বিএনপি নেতা শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক, আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়েছিলো। এ সময় তারা দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিসহ দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিদেশে অবস্থানকালে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে একবার ফোনে কথা বলেছিলেন।
আটক করে কাউকে কাউকে আবার ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো : ওয়ান-ইলেভেনে যৌথবাহিনীর সদস্যরা কোন কোন নেতাকে আটক করলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে আবার ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাদের আটকের পর দীর্ঘদিন অজ্ঞাতস্থানে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন করেছেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। পরে আবার চোখ বেঁধে ছেড়ে দিয়েছিলেন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। যৌথবাহিনীর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই তারা দেশ ছেড়েছেন।
এদেরই একজন বিএনপি নেতা শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক। তিনি ছাড়া পাওয়ার পর প্রথমে সিঙ্গাপুর এবং পরে জার্মানী চলে যান। সিঙ্গাপুরে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোর্শেদ খানসহ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বেশ কিছু নেতার সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিলো।
দেশে আত্মগোপন করেছিলেন কোন কোন নেতা : আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য বরকত উল্লাহ বুলু, বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য রশিদুজ্জামান মিল্লাতসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা দেশেই আত্মগোপন করেছিলেন। এ সময় তারা বেশ-ভুষা পরিবর্তন করেছিলেন। কেউ কেউ দাড়ি রেখেছিলেন। জেলে যারা গিয়েছিলেন তারা দিনের বেলা আলো বাতাস দেখতে পেতেন এবং সপ্তাহে অন্তত একবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু যারা দেশে আত্মগোপন করেছিলেন তাদের কেউ কেউ পুরোটা সময় একটি রুমের মধ্যেই কাটিয়েছেন। সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন। দেশে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের নিজস্ব বক্তব্যে এমনটা জানা গেছে।
নির্বাচনের আগেই দেশে ফেরেন দেশত্যাগী নেতারা : ওয়ান-ইলেভেনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া নেতারা ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেই দেশে ফিরে আসেন। বিশেষ করে দুই নেত্রী জামিনে মুক্তি পাবার পরপরই দেশে ফিরতে শুরু করেন নেতারা। ওয়ান-ইলেভেনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মূখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকী, তার বিশেষ সহকারি হারিছ চৌধুরী, হাওয়া ভবনের মুখপাত্র আশিক ইসলাম, তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সহকারি মিয়া নুরুদ্দিন অপুও দেশ ছেড়েছিলেন। এদের মধ্যে আশিক ইসলাম, মিয়া নুরুদ্দিন অপু বেশ কয়েকবার দেশে আসলেও ড. কামাল সিদ্দিকী ও হারিছ চৌধুরী দেশে ফেরেননি একবারের জন্যও। হারিছ চৌধুরীকে কেউ দেখেছেন এমন কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি তার জেলার নেতারাও এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
Leave a Reply