বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা। দুই নেত্রীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার, ব্যবসায়ীদের হয়রানি করে অর্থ আদায়সহ নানা গুরুতর অভিযোগ উঠলেও কুশীলবদের এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হয়নি। ফলে প্রায় সবাই আছেন বহাল তবিয়তেই। নির্বিঘ্নে নিজেদের মতো করে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। বেশির ভাগই আছেন বিদেশে। এর মধ্যে প্রধান কুশীলব ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন উ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই আছেন। সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) চৌধুরী ফজলুল বারীও থাকছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। থাইল্যান্ডে চিকিত্সারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। সে সময় প্রভাবশালীর ভূমিকায় থাকা সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী টানা ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন শেষে এখন ঢাকায় অবসর যাপনের পাশাপাশি পাঁচ তারকা মানের রেস্টুরেন্ট খুলে ব্যবসা করছেন। ওয়ান-ইলেভেনে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তা হিসেবে দোর্দণ্ড প্রতাপে থাকা মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন দুবাইয়ে চাকরি করেছেন কয়েক বছর। তিনি ও ডিজিএফআইয়ের অপর ক্ষমতাধর মেজর জেনারেল (অব.) সাঈদ জোয়ার্দার দুবাই-কানাডা যাওয়া আসার মধ্যে আছেন বলে বিভিন্ন সূত্র বলছে। চাকরিচ্যুত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। জানা যায়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন দেশ ছেড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। অবশ্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন আগে থেকেই। এই দফায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে বাড়ি কেনেন মেরিল্যান্ড স্টেটের পটোম্যাকে। সেখানে তার দুটি বাড়ির একটিতে থাকেন সস্ত্রীক ও অপরটিতে থাকে তার কন্যার পরিবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিষয়ে ভিসিটিং স্কলার হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শিক্ষার্থীদের ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ’ সম্পর্কে শিক্ষা দেন। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণ বিষয়েও শিক্ষার্থীদের পড়ান প্রায় বিশ বছর বিশ্বব্যাংক ও পাঁচ বছর পিকেএসএফে দায়িত্ব পালন করা ফখরুদ্দীন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর নেন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের মাঝামাঝি। সে বছরেরই ১৪ জুন তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে ফ্লোরিডায় ছোট ভাই ও ছেলের কাছে থাকতেন। পরে তার ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিত্সার জন্য নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হয় বা গ্রিনকার্ড পান। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশেষ সুবিধায় নিউইয়র্কের হাসপাতালে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিত্সা নেন। পরে দার স্পাইনাল কর্ডে ৫টি স্থানে ক্ষত হওয়ায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনও করা হয়। কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও ২০১৫ সালে ফ্লোরিডায় একটাি রবীন্দ্র সম্মেলনের মঞ্চে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে সামনে আসেন জেনারেল মইন। এর মধ্যে ‘শান্তি পথে’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ওয়ান-ইলেভেন সংশ্লিষ্ট কিছু কথা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হওয়া অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ চার বছর আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি ৮১ বছর বয়সে থাইল্যান্ডে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। শেষ সময়ে তিনি বয়সের ভারে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন। কাটিয়েছেন গুলশানের বাসভবনে। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানেই যোগ দেননি।
ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার অভিযানের জন্য গঠন করা ‘গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র প্রধান সমন্বয়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুুরী ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চার দফায় মোট ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ায় দায়িত্ব পালন করে ২০১৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। এখন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় একটি ফাইভ স্টার মানের রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুুরী। দুই মেয়ে বিদেশে থাকায় সস্ত্রীক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের আরেক আলোচিত ও সমালোচিত সামরিক কর্মকর্তা (চাকরিচ্যুত) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে ব্রিগেডিয়ার বারী ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাচির চাকরি নিয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেও তিনি ফেরেননি। পরে তার স্ত্রীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ অভিবাসীর স্ট্যাটাস পান। মাঝে ডমিনাস পিজা ও ওষুধ কোম্পানির ডেলিভ্যারি ম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন বলেও তথ্য আছে।
ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন ২০০৯ সালের ১৭ মে সব আর্থিক সুবিধাসহ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ে দেশত্যাগ করেন। সর্বশেষ দুবাইয়ে অবস্থান করে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি করছেন বলে জানা যায়। সেখানেই আছেন ডিজিএফআইয়ের সে সময়ের অপর ক্ষমতাধর মেজর জেনারেল (অব.) সাঈদ জোয়ার্দারও। তারা কানাডায় যাওয়া-আসা করেছেন বলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ওয়ান-ইলেভেনের আগে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধূরী পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর জাতীয় সংসদে চরম সমালোচিত হয়ে ২০০৯ সালের ২ এপ্রিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় ডিওএইচএসের বাসাতেই থাকছেন। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি ব্যায়াম করেন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি তাকে দুদকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কৈফিয়ত দিতে ডাকলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরজুড়ে উপদেষ্টা থাকা মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মতিন ছিলেন সে সময়ের গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটিরও প্রধান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে বসবাস করে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করছেন।
ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অত্যধিক সক্রিয় ভূমিকায় থাকা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দৈনিক ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়ে নিজের আইন পেশায় ফেরেন। উচ্চ আদালতের বিভিন্ন ইস্যুতে সরব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে বিভিন্ন টকশোতে উপস্থিত হতে দেখা যায়। উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান নিজের এনজিও পিপিআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার পরামর্শক হিসেবেও ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যতটা সরব ছিলেন এখন তেমন সরব না হলেও আইন পেশায় নিয়মিত।
বিদেশি কূটনীতিক : ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর অভিযোগ ওঠে। সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রেসিয়া এ বিউটেনিস ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকার দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যান। পরে তিনি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচার দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। বিউটেনিসের পরপরই ঢাকায় আসা জেমস এফ মরিয়ার্টিও কূটনীতি থেকে অবসরে গেছেন। কিন্তু ২০১৫ সালে গার্মেন্ট ব্যবসার সক্ষমতা বাড়াতে একটি ত্রিপক্ষীয় জোটের ঢাকার প্রধান সমন্বয় হিসেবে এসে এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করছেন মরিয়ার্টি। তত্কালীন সময়ে ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার চৌধুরী বর্তমানে পেরুতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে তিনি ব্রিটিশ সরকারের ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন্সের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আনোয়ার চৌধুরীর পরে দায়িত্ব পালন করা স্টিভেন ইভান্সও দায়িত্ব পালন শেষে লন্ডনে পররাষ্ট্র দফতরে কাজ করছেন। সে সময় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী হিসেবে বিতর্কিত ভূমিকা রাখা রেনাটা ডিজালিয়েন মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির দায়িত্বে গিয়েও বিতর্কিত হয়েছেন। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘের অবস্থানের বাইরে গিয়ে মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন করছিলেন, এমন অভিযোগে রেনাটাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে মিয়ানমার থেকে।
সূত্র: সিলেট ভিউ
Leave a Reply