জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা হয় মালয়েশিয়ায় বসে

মালয়েশিয়ায় বসে জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। এই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) দুই জঙ্গি রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও মোস্তাক।

এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় তারা মোবাইল ফোনে বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে খুদেবার্তা আদান-প্রদান করে। রানার মোবাইল সেট পরীক্ষা করে জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত এ খুদেবার্তা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার ল্যাপটপে আইএস হামলার এক হাজারের বেশি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়। গুলশানে হলি আর্টিসানে হামলার ফুটেজও রয়েছে রানার ল্যাপটপে।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) একটি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। বিভিন্ন সময় জঙ্গিদের একাধিক ‘হিট লিস্টে’ জাফর ইকবালের নাম থাকলেও এই প্রথম কোনো জঙ্গির মোবাইল ফোনে এ-সংক্রান্ত খুদেবার্তা পাওয়া গেল।

এ ছাড়া রানার সঙ্গে কাজী মো. রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের যোগাযোগ ছিল। নাফিস নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে হামলার ষড়যন্ত্র করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তার ৩০ বছরের কারাদ হয়েছে।

সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজীবের হত্যাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই রানার সঙ্গে নাফিসের যোগাযোগের বিষয়টি পুলিশ জানতে পারে। তবে তখন রানা সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায়নি।

সিটিটিসির ডিসি মুুহিবুল ইসলাম খান বলেন, রানা, জুন্নন ও নাফিস একই গ্রুপের ছিল। তারা পরস্পর বন্ধু। রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবিটির ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

দেশে ব্লগার হত্যার সূচনাকারী এবিটির অন্যতম সংগঠক রানা। আহমেদ রাজীব হায়দার ছাড়াও একাধিক ব্লগার হত্যা ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় রানার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। রাজীব হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি রানা। মালয়েশিয়ায় পালিয়ে থাকা রানা ও তার সহযোগী আশরাফুল ইসলামকে সে দেশের গোয়েন্দারা আটকের পর সোমবার ফেরত পাঠায়। বিমানবন্দর থেকে অনুসরণ করে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় তাদের গ্রেফতার করে সিটিটিসির কাছে তুলে দেয় পুলিশ। দু’জনকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, রানার কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ ও তিনটি মোবাইল ফোন সেট পাওয়া গেছে। রানা তার মোবাইল ফোন থেকে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত এবিটির আরেক সদস্য মোস্তাককে খুদেবার্তা পাঠিয়ে জানায়, ‘যে কোনো উপায়ে জাফর ইকবালকে হত্যা করতে হবে।’ জিজ্ঞাসাবাদে রানা জানিয়েছে, মোস্তাকের বাড়ি সিলেটে। দীর্ঘদিন সে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। জাফর ইকবালকে হত্যার পরিকল্পনা করার কারণ হিসেবে রানা জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া বক্তব্যে জঙ্গি সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণেই তাকে টার্গেট করা হয়।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নব্য জেএমবির গুলশানে হামলার ভিডিও ফুটেজ রানার ল্যাপটপে পাওয়া গেছে। হামলার দিন ভোরে সিরিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশি জঙ্গি জুন্নন শিকদার প্রথম রানাকে ফোন করে হামলার ব্যাপারে তথ্য দেয়। জুন্নন তাকে জানায়, এ ধরনের হামলা বাংলাদেশে আরও হবে। রানা জানিয়েছে, জুন্ননের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। রানাও সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে তুরস্কের সীমান্তে কঠোর নজরদারি ও পাসপোর্ট নিয়ে কিছু সমস্যার কারণে মালয়েশিয়া থেকে সিরিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আগ্রহ হারায় সে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এখনও গুলশানে হামলাকারী নিবরাসসহ পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে যোগাযোগ ও মনিপুর স্কুলের এক শিক্ষককে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে মুখ খোলেনি রানা।

গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে রানা আরও জানায়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ক্যাম্পাসে সপ্তাহে এক দিন ‘ওপেন ফোরামে’ জিহাদের ব্যাপারে বক্তব্য রাখা হতো। সেখানে নিয়মিত ‘ক্লাস’ নিত জুন্নন ও নকীব। জুন্ননের বাসাতেই রাজীব হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল। তার মাধ্যমে রানা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। জুন্নন তাকে জানিয়েছে, সিরিয়ায় সে আইএসের সামরিক শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছে। সেখানে যাওয়ার জন্য রানাকে আমন্ত্রণ জানায় জুন্নন। তবে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজীব হত্যার মূল পরিকল্পনার বিষয়টি রানা এখন জুন্ননের ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। এই মামলায় গ্রেফতার অন্য কারও জবানবন্দিতে জুন্ননের নাম আসেনি। তারা রাজীব হত্যার মূল পরিকল্পনা ও সমন্বয়কারী হিসেবে রানার নাম বলেছে।

জানা গেছে, রানা জানিয়েছে উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর হামলার বিষয়টি সে জানত। সে ওই হামলায় জড়িত নয়। নাফিস তার পুরনো বন্ধু। নিউইয়র্কে থাকার সময় নাফিসের সঙ্গে ইন্টারনেটে যোগাযোগ হতো রানার। সে জানত, নিউইয়র্কে ‘কিছু একটা’ ঘটানোর পরিকল্পনা করছে নাফিস। ২০০৮ সাল থেকে আশরাফুল মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। তাকে জঙ্গিবাদে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল রানা।

গোয়েন্দারা বলছেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে মালয়েশিয়া পালিয়ে যাওয়ার পরও সেখানে বসে দেশি-বিদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত রানা।

সূত্র : সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর