আগামী ৮ই ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবিসংবাদিত নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং আরো চার নেতার দূর্নীতির মামলার রায় ঘোষিত হবে। এই রায় যে জাতির বিশেষ করে রাজনৈতিক জীবনে কি ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করবে সেটি জনগণের ঘরোয়া কথাবার্তায় এবং বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট, ভাষ্য ও টক শোতেই বোঝা যাচ্ছে। রায় প্রকাশের এখনো ৮দিন বাকি আছে। অথচ এর ৭দিন আগে থেকেই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে কৌতুহল উদ্বেগ ও আতংক প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কারো বাসায় বেড়াতে গেলে অথবা আপনার বাসায় কেউ বেড়াতে এলে প্রথম কুশলাদি বিনিময়ের পর, অন্য সব বিষয় আলোচনার আগে সর্বাগ্রে যে আলোচনাটি আসছে সেটি হলো, ভাই, ৮ তারিখে কি হবে? পরের প্রশ্ন হলো খালেদা জিয়ার কি শাস্তি হবে? খালেদা জিয়ার যদি শাস্তি হয় তাহলে বিএনপি বা ২০ দল কি করবে? এক শ্রেণীর মিডিয়াতে খবর বেরিয়েছে যে শেষ পর্যন্ত বেগম জিয়ার যদি শাস্তি হয় এবং সেটি এমন শাস্তি যার ফলে বেগম জিয়া, তারেক রহমান প্রমুখ নেতা নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে পড়েন তাহলে নাকি বিএনপি তথা ২০ দল হরতাল অবরোধ মিছিল প্রভৃতি রাজনৈতিক কর্মসূচী দেবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল আশংকা করছেন যে এসব কর্মসূচী দেশে যে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দেবে তার ফলে দেশের রাজনীতিতে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। এবং সেই উত্তেজনা চূড়ান্ত পরিনামে সহিংসতার জন্ম দিতে পারে।
কারণ এই সরকার এখনো বিএনপিকে সভা সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। ছোটখাটো মিছিল বের করলেই এখনো সেখানে লাঠিচার্জ করা হচ্ছে এবং টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হচ্ছে। এখনো প্রতিদিন বিরোধী দলের নেতা ও কর্মীদেরকে গ্রেফতার করা অব্যাহত রয়েছে। যে কোন রকম বড় ধরনের সভা অনুষ্ঠানের চেষ্টা অথবা মিছিল মিটিংকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে হরতাল বা অবরোধের মত কর্মসূচী পালন করার প্রচেষ্টাকে শুধু সন্ত্রাসী নয়, একেবারে জঙ্গী তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করা হবে। এরকম রাজনৈতিক রেজিমেনটেশনের মধ্যে বিএনপি তথা বিরোধী দলের প্রতিবাদী কর্মসূচী কতদূর সফল হবে সেটি নিয়েও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যে প্রবল সংশয় রয়েছে। তাই রাজনৈতিক মহলে জল্পনা কল্পনা চলছে যে সরকারী দমন নীতির মুখে যদি বিরোধী দল সমূহের প্রতিবাদী কর্মসূচীর সাফল্যের সম্ভাবনা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে তাহলে বিরোধী দলের জন্য আর কি বিকল্প থাকবে?
\ দুই \
তখন একটি বিকল্প থাকবে আইনী লড়াই। যদি বেগম জিয়ার ২ বছরের কারাদন্ড হয় এবং তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হন তাহলে সেই কারাদন্ড কার্যকর করার চেষ্টা করা হবে। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার পক্ষে আইনী লড়াইয়ের পরবর্তী ধাপ হবে উচ্চতর আদালত অর্থাৎ হাইকোর্টে আপীল করা। হাইকোর্টে আপীল করলে এখানে দুইটি সমস্যা বা সম্ভাবনার উদ্ভব ঘটবে। প্রথমটি হলো হাইকোর্টে আপীল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া, অর্থাৎ স্টে অর্ডার দেওয়া। দ্বিতীয় হলো বেগম জিয়াদেরকে জামিন দেওয়া, কিন্তু দন্ডাদেশ স্থগিত না করে মামলা চালিয়ে যাওয়া। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে স্টে অর্ডারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীন। তবে যেহেতু অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলা কোনো মার্ডার কেস নয় এবং দৃশ্যত কোন তহবিল তছরূপ নয়। এক্ষেত্রে তহবিল তছরূপ না হয়ে মূল তহবিল বরং তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে মামলা চলা সাপেক্ষে বেগম জিয়ার জামিন হয়তো মঞ্জুর হতে পারে।
এই রায়ে যদি বেগম জিয়ার কারাদন্ড হয় তাহলে তাকে হয়তো কেরানীগঞ্জ বা কাশিমপুর কারাগারে নাও নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে মঈনুদ্দীন ফখরুদ্দীন সরকারের মত কোন একটি বাসা বাড়ীকে সাব জেলে রূপান্তর করে বেগম জিয়াকে সেখানে রাখা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়া সাব জেলে থাকবেন, কিন্তু হাইকোর্টে মামলা চলতে থাকবে।
যদি নিম্ন আদালতের রায় হাইকোর্টেও বহাল থাকে তাহলে বিএনপি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করবে। আইনের স্বাভাবিক গতি অনুযায়ী আপীল বিভাগ থেকে যে রায় দেওয়া হবে সেটাই হবে চূড়ান্ত। নিম্ন আদালতের রায় প্রসঙ্গে একটি সম্ভাবনার কথা বলা যায়। সেই সম্ভাবনাটি অত্যন্ত ক্ষীন হলেও নিরপেক্ষতা এবং বস্তুুনিষ্ঠতার খাতিরে সেটি উল্লেখ করতে হয়। সেটি হলো, এই মামলার আসামী পক্ষ অর্থাৎ বেগম জিয়াদেরকে বেকসুর খালাস দেওয়া অথবা এমন লঘু দন্ড প্রদান যার ফলে তিনি দন্ড প্রাপ্ত হলেন কিন্তু নির্বাচনের অযোগ্য হলেন না। এই সম্ভাবনা রাজনৈতিক বিবেচনায় অত্যন্ত ক্ষীন। কারণ তাকে খালাস দেওয়া হলে বা লঘু দন্ড দেওয়া হলে তিনি জনগণের চোখে হিরো উঠবেন, যেটি আওয়ামী লীগের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। যাই হোক, তর্কের খাতিরেই ধরা হোক যে নিম্ন আদালতের গুরু দন্ড আপীল বিভাগেও বহাল রইল তাহলে পরবর্তী ধাপ হলো রিভিউ পিটিশন করা। রিপোর্ট বেরিয়েছে যে আগামী ১৯ শে এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। তিনি হলেন একজন হার্ডকোর আওয়ামী লীগার। তার কাছে বিচার চাইবার মতো মানসিকতা বেগম জিয়ার হবে বলে মনে হয় না।
\ তিন \
এখানে সময় একটি বড় ফ্যাক্টর। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মধ্যম পর্যায় পর্যন্ত সব লেভেলেই বলা হচ্ছে যে বেগম জিয়ার শাস্তি হবেই। এমন কি রায়ের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে মোতায়েন করা হবে। তাদের ওপর নির্দেশ থাকবে, রায়ের বিরুদ্ধে যেন কোন রকম বিক্ষোভ হতে না পারে এবং কোন রকম অশান্তি না হয়। এসব থেকে রাজনৈতিক মহল ধারণা করছে যে রায়টি মোটামুটি পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ১১ মাস আগে রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল যদি রাজপথে নামে তাহলে সেই আন্দোলন ১১ মাস ধরে সাসটেইন করা যাবে কিনা সেটিও একটি প্রশ্ন। সেই ক্ষেত্রে রায় ঘোষণার পর কয়েকদিন প্রতীকি কিন্তু শক্ত প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হবে। এরপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ইতিমধ্যেই বিরোধী দলের সম্ভাব্য আন্দোলন যাতে গড়ে উঠতে না পারে অথবা আন্দোলনটিকে যাতে দুর্বল করা যায় সেই জন্য এখন থেকেই নানারকম গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ পন্থী কোন কোন মিডিয়া থেকে বলা হচ্ছে যে ২০ দলের মধ্যে কোন কোন শরিক দল নাকি অবিলম্বে সর্বাত্মক আন্দোলনের বিরোধীতা করছে। তারা নাকি বলছেন যে সর্বাত্মক আন্দোলনের এখনো নাকি সময় আসেনি। ২০ দলীয় জোটের ২/৩টি বড় শরিক এবং গুরুত্বপূর্ণ শরিকের সাথে কথা বলে জানা গেল যে বেগম জিয়ার সম্ভাব্য শাস্তি, শাস্তি কেন্দ্রিক সম্ভাব্য আন্দোলন বা আগামী দিনের নির্বাচন কেন্দ্রিক আন্দোলন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি বা ২০ দলীয় জোটের সাথে বেগম জিয়ার যে ধারাবাহিক বৈঠক সমূহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই সব বৈঠকে মতদ্বৈধতার কোন আলামত দেখা যায়নি। বরং জামায়াতে ইসলামীর মৌলানা আব্দুল হালিম এবং আরো ২/১টি ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বলেছেন যে ২০ দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তারা সম্পূর্ণভাবে বেগম খালেদা জিয়ার ওপর অর্পণ করছেন। এ ব্যাপারে বেগম জিয়া যে সিদ্ধান্তই নেবেন সেই সিদ্ধান্তই তারা বিন বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবেন।
কিন্তু প্রশ্নটি সেটা নয়। এখনতো কেবল একটি মামলা অর্থাৎ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলার রায় অপেক্ষমান। এরপরে দ্রæত রায় হবে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার। এই দুটি মামলা ছাড়া বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে পেন্ডিং রয়েছে আরো ৩৩টি মামলা। এর মধ্যে আবার নতুন আরেকটি মামলা যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো ২০১৫ সালের মামলা। তখন ৫ই জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী চলছিল প্রবল আন্দোলন। সেই সময় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলমান বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। ঐ বোমা নিক্ষেপ মামলায় ৩ বছর পর বেগম জিয়াকে হুকুমের আসামী করে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে এই মামলাকে ঘিরে একটি বিষয় ক্রমশ:ই ওপরে উঠে আসছে। সেটি হলো বেগম জিয়াকে শাস্তি না দিলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে। সরকার মুখ দেখাতে পারবেনা। আবার তার যদি শাস্তি হয়, যদি জেল খাটতে হয় এবং যদি তাকে নির্বাচনের অযোগ্য করা হয় তাহলেও সেই শাস্তি জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। ফলে তার জনপ্রিয়তা অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে। ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার নিরিখে বেগম জিয়া শীর্ষ স্থানে আছেন। এরও পরে যদি তার ঐসব শাস্তি হয় তাহলে তার জনপ্রিয়তার পারদ শুধু ওপরেরই উঠতে থাকবে।
আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রবীণ দল। বয়স ৬৯। অনেক উত্থান পতন এবং সরকারী দমন নীতির মধ্য দিয়ে দলটি আজ এই পর্যায়ে এসেছে। তারা দেখেছে যে দমন পীড়ন দিয়ে একটি দল বা একাধিক নেতাকে সাময়িকভাবে দাবিয়ে রাখা যায়, কিন্তু চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করা যায় না। এর জ্বলন্ত প্রমাণ হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন ইতিমধ্যেই জনগণের মধ্যে বলাবলি শুরু হয়েছে যে বেগম জিয়া এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে যে দমন পীড়ন চলছে তার ফলে তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের জনপ্রিয়তা সরকারই বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজনীতি ২/১ বছরের ব্যাপার নয়। এই মামলায় যদি বেগম জিয়ার শাস্তি হয় তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বেগম জিয়ার স্থান কোথায় নির্ধারিত হবে সেটি সম্পর্কে ইতিহাসবিদরা ইতিমধ্যেই আগাম ধারণা দেওয়া শুরু করেছেন, তবে সেটি এখনো প্রকাশ্যে নয়, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়।
সৌজন্যে: মোবায়েদুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাব থেকে সংগৃহিত।
Leave a Reply