পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করলেও খবরটি সময়মতো পাননি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি খবর পান আরও ২৪ দিন পর।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার ‘আওয়ামী লীগ যুদ্ধ দিনের কথা-১৯৭১’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকে। ফলে তিনি ওই সময় অন্ধকারে ছিলেন। পরে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার রেজাউল করিমের মুখ থেকেই বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার তথ্যটি জানতে পারেন।
তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাইকমিশনার রেজাউল করিমের লেখাসহ একাধিক বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের আলোকে বইয়ে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার আলাপ আলোচনার উদ্বৃতি দিয়ে শুক্রবার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ ও দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি জেনেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে কারাগারে ছিলেন তার দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিআইজি আবদুর রহমান বঙ্গবন্ধুকে খবরটি জানিয়েছিলেন। পরে ওই জেলখানা নিরাপদ মনে না হওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে অনত্র্য সরিয়ে নেন ওই ডিআইজি।’
মহিউদ্দিন আহমদ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘দুই দশকের একটানা রাজনৈতিক লড়াইয়ের শেষে একটি রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু তখনও বন্দি ছিলেন। পরে কারামুক্ত হয়ে তিনি লন্ডনে পৌঁছানোর খবর শোনা মাত্রই বাংলাদেশের সব মানুষ আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায়। মনে হয়, তারা এবার স্বাধীনতার আসল স্বাদ পেলো। যা শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ছিল অপূর্ণ। শেখ মুজিবকে ২৬ ডিসেম্বর জেল থেকে প্রথমে একটি অতিথিশালায় নেওয়া হয়। এক রাত সেখানে থাকর পর তাকে রাওয়ালপিন্ডির সিহালা গেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়। ২৭ ডিসেম্বর ভুট্টো (জুলফিকার আলী ভুট্টো) শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। ভুট্টো যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন বঙ্গবন্ধু তখনও জানতেন না।’
উল্লেখ্য, যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর সম্ভাব্য সেনাবিদ্রোহের মুখে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ভুট্টোকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। ভুট্টো রোম থেকে এসে দায়িত্ব নিয়েই ইয়াহিয়াকে অন্তরীণ ও সাত জেনারেলকে বরখাস্তের নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভুট্টোর কথোপকথনও তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধদিনের কথা-১৯৭১ বইটিতে। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন, সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজের সহযোগিতায় ভারতীয় সেনবাহিনী ঢাকা দখল করেছে, তিনি (ভুট্টো) বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি এসব কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ‘ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই‘ করতে ভুট্টোর সহযোগিতাও চেয়ে বসেন।
ওই সাক্ষাতে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ঐক্যের কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে তাতেও তিনি রাজি রয়েছেন বলে জানান। বঙ্গবন্ধু যেভাবে চেয়েছিলেন পাকিস্তানে সেভাবে সংবিধানও তৈরির কথা জানান। ওই সময় ভুট্টো পাকিস্তানকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধুর কাছে আকুতিও জানান।
বঙ্গবন্ধুকে ‘মুজিব ভাই‘ সম্বোধন করে একসঙ্গে থাকার কোনও সম্ভাবনা রয়েছে কিনা- সেটাও জানতে চান। তবে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি এ ব্যাপারে এখন কথা দিতে পারছেন না। দেশের লোকদের সঙ্গে কথা বলে একটা কিছু করার চেষ্টা করবেন। মূলত বঙ্গবন্ধু এসব কথা ভুট্টোকে খুশি করতে, নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সন্দেহ ছিল তাঁকে আটকে রাখার জন্য নানা ছুতো তৈরি হতে পারে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খানের উদ্বৃতি দেওয়া হয়েছে বইয়ে।
বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে যে গেস্ট হাউসে রাখা হয়েছিল সেখানে ড. কামাল কামাল হোসেনকেও নিয়ে আসা হয়। এমনকি ওই গেস্ট হাউসে তাদের জন্য রেডিও ও সংবাদপত্র সরবরাহ করা হয়। পরে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানি এয়ারলাইন্সের বিমানে বঙ্গবন্ধু ও ডা. কামালকে লন্ডনে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। রওনা হওয়ার আগে ভুট্টো আবারও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা একত্র রাখার প্রস্তাব দেন। কনফেডারেশেনের কথাও তিনি ওই সময় বলেন। তবে জবাবে, বঙ্গবন্ধু অপেক্ষা করতে বলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর জানা প্রসঙ্গে বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও একটি ঘোরের মধ্যে ছিলেন। হিথ্রো বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েথ বিষয়ক দফতরের কর্মকর্তা আয়ান সাদারল্যান্ড। .. . . . বিমানবন্দর থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মিশন প্রধান রেজাউল করিমের কাছে শুনতে থাকেন, কী ঘটে গেছে এই দিনগুলোতে। বন্দি থাকা অবস্থায় অনেক কিছুই ছিল তার অজানা। রেজাউল করিমের কাছে সব শুনে তিনি অবাক বিস্ময়ে শুধু বলেন, ‘আমরা সত্যি স্বাধীন হয়েছি।’
প্রসঙ্গত: বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান বোয়িং ৭০৭ লন্ডনে পৌঁছায় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি সকালে।
তবে এ বিষয়ে ড. কামাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে হরিপুর কারাগার থেকে আমাকে তার রেস্টহাউসে নেওয়া হয়। ২৮ ডিসেম্বর আমার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তখন আমি বুঝতে পারি দেশ স্বাধীন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে ভুট্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং ওই সময় গত কয়েকদিনের ঘটনা জানিয়েছিলেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে জানান, জেলে বসেই বিজয়ের খবর পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে ডিআইজি আবদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনিই তাকে নিয়াজির আত্মসমপর্ণের কথা জানিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরে ওই ডিআইজি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, দেখেন, আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, আমি নিজের দায়িত্বে আপনাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই। কেননা, জেলের ভেতরে অবস্থা খুব খারাপ। এটা নিয়াজির জন্মস্থান। নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছে। এখানকার জনগণ মনে করে এটা খুব অপমানজনক, অসম্মানজনক ইত্যাদি। তারা অন্যভাবে এটাকে দেখছে। তারা ভাবছে এটার প্রতিশোধ নিতে হবে। ডিআইজি বলেন, আমি আপনাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে রাখবো। আমার পুলিশ পার্টি আছে তারা আপনাকে পাহারা দেবে।’
পরে বঙ্গবন্ধু ওই ডিআইজির ওপর বিশ্বাস রেখে তার জিম্মায় বঙ্গবন্ধু একটি প্রজেক্ট এলাকায় গিয়ে ২/৪ দিন ছিলেন। সেখান থেকে তাকে হেলিকপ্টারে করে প্রথমে একটি অতিথিশালা ও পরে সাহলা রেস্টহাউসে নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি জানার বিষয়ে ড. কামাল হোসেনের অভিমত নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দিতে না চাইলেও নিজের তথ্যকে অধিকতর সত্য বলে মনে করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। এ বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘তিনি যে তথ্যটি লিখেছেন তা লন্ডনের হাইকমিশনার রেজাউল করিমের লেখা থেকেই নেওয়া। তাছাড়া তিনি নির্ভরযোগ্য আরও একাধিক বইয়ে এবং একাধিক ব্যক্তির মুখে এ তথ্যটি জেনেছেন।’
ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ ধরনের কথা তিনি আগে শোনেননি। আর এটা যদি সত্যি হতো তাহলে বঙ্গবন্ধু অন্য কোথাও এটা উল্লেখ করতেন। কিন্তু এমনটি তিনি কখনও কারও কাছে বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
Leave a Reply