আল হাছিব তাপাদার:: মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর কাছে সভ্রম হারিয়েছেন লক্ষাধিক মা-বোন। সামাজিক লোক-লজ্জায় ও ভয়ে কেউ সভ্রম হারানোর কথা শিকার না করলেও সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বীরাঙ্গনা এসনু বেগম নিজের উপর পাক হানাদারদের চালিত নির্যাতনের কথা শিকার করে অনেক বর্ণনা দিয়েছেন।
২০১৬ সালে রাষ্ট্রীয় মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে সরকার তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি জকিগঞ্জের একমাত্র বীরাঙ্গনা মুক্তিযুদ্ধা। ২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রকাশিক ৩টি তালিকার প্রথম তালিকার ছয় নম্বরেই রয়েছে তার নাম। তিনি উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের মনতইল গ্রামের মৃত ময়গুন বেগম ও রিয়াছদ আলীর মেয়ে। এখন তার বয়স প্রায় ৬০ বছর পাড়ি দিচ্ছে।
বিজয়ের ৪৭ বছর পূর্তি নিয়ে বীরাঙ্গনা এসনু বেগমের সাক্ষাতকার চাওয়া হলে তিনি তার দুর্বিষহ জীবনের করুণ ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। একাত্তরের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মা-বাবার সংসারে তিনি ছিলেন একা। দুই বোন লেবু বিবি ও লেচু বিবির বিয়ে হয়ে যায় যুদ্ধের আগেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৩/১৪ বছরের কিশোরী। শুধু তার গ্রাম নয় আশপাশ গ্রামেও তার মতো সুন্দরী মেয়ে কম ছিল। এ কারণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার উপর। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে একদিন গভীর রাতে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তার বাড়ীতে হানা দেয় পাকবাহিনী। চোঁখমূখ বেঁধে নিয়ে যায় প্রথমে শাহগলী বাজারস্থ পাকিস্থানী বাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে তাকে জকিগঞ্জ শহরের ক্যাম্পে এনে ক্যাপ্টেন বশারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। জকিগঞ্জ শহরের ক্যাম্পে টানা তিনদিন এসনুর উপর পাকিস্থানী অফিসাররা ও স্থানীয় রাজাকাররা পালাক্রমে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের পর এসনু বেগমকে শাহগলীতে নিয়ে পৌছে দেয় হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
জকিগঞ্জে বীরাঙ্গনা এসনু বেগম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এখনো সেই দিনের সেই পাশবিক নির্যাতনের কথা মনে হলে আৎকে উঠেন। পাক বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হবার কারনে তাকে কেউ বিয়ে করেনি। অনেকে উপহাস করে তাকে পাঞ্জাবির স্ত্রী বলে ডাকতো। এক সময় একই গ্রামের দিনমজুর বৃদ্ধ জমির আলীর সাথে বিয়ে হয় এসনু বেগমের। বিয়ের কিছুদিন পরই মারা যান এসনু বেগমের স্বামী জমির আলী। নিঃসঙ্গ এসনুর সামান্য এক টুকরো জায়গা ও জীর্নশীর্ন একটি ঘর ও একটি কন্যা সন্তান ছাড়া আর কিছুই নেই। একাত্তরের বীরাঙ্গনা এসনু বেগমকে এখনো একাত্তরের সেই ভয়াবহ স্মৃতি তাড়া করে। জীবন সায়াহ্নে এসেও এই পৈশাচিকতার বিচার চান এসনু বেগম।
মুক্তিযোদ্ধা এসনু বেগমের বাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণশীর্ণ ঘর, দরজা জানালা ভাঙ্গা, ভাঙ্গাচোরা বাঁশের বেড়া, ঘরের ভিতর একটি কাঠের চৌকিতে অগোছালো বিছানা। এরই মাঝে তাঁর বসবাস। প্রায় ১৭ বছরপূর্বে বাবা এবং প্রায় ১১ বছর আগে তার মা মারা যান। বৃদ্ধ অসহায় এসনু দু’মূটো ভাত যোগান করেন শীতলপাটি ও বাঁশ দিয়ে ডাম, চাটাই ইত্যাদি তৈরী করে। অভাব তাকে নিয়মিত তাড়া করলেও কোনদিন কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি।
এসনু বলেন, ২০১৬ সালে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু অন্য কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না। বাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি ঝুপড়ি ঘরে এখনো বাস করেন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবপ্রাপ্ত এসনু বেগম। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তার খোঁজখবর নিতে কেউ আসেননি বলে অভিযোগ তার। তিনি জীবনের শেষ সময়ে একটি ভালো ঘরে বসবাস করে মরতে চান। কিন্তু কবে তার স্বপ্ন পূরণ হবে তা নিয়ে তিনি অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন তিনি।
এ ব্যাপারে উপজেলা মুক্তিযুদ্ধা কামান্ডার ও পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী খলিল উদ্দিন জানান, মুক্তিযোদ্ধা এসনু বেগমের বসত ঘর তৈরি করে দেওয়ার জন্য মন্ত্রনালয়ে একটি সুপারিশ প্রেরণ করা হয়েছে। আমি আশাবাদী এসনু বেগমকে সরকার দ্রুত ঘর উপহার দিবে।
Leave a Reply