ডেস্ক প্রতিবেদন:
“সাধক শিতালং শাহ’র গান আসামের রেডিও টেলিভিশনে
এখনো প্রচার হয়”
ডেস্ক প্রতিবেদন:
বরাক-সুরমার উৎপত্তিস্থল জকিগঞ্জের বারঠাকুরীতে শুয়ে আছেন অসংখ্য আধ্যাত্বিক গানের অমর ¯্রষ্টা সুফি সাধক শাহ শিতালং রা.। ভারতের করিমগঞ্জ জেলার বদরপুর থানার শ্রীগৌরী পরগনার ‘শিলচর’ গ্রামে তার জন্ম। তাঁর পিতার নাম জাঁহা বখশ উরফে কামাল শাহ।
শিতালং শাহর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ। জনশ্রুতি রয়েছে জাঁহা বখশ ঢাকার নবাব পরিবারের লোক ছিলেন। ব্যবসা করতেই তিনি এ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বারঠাকুরী গাইবী দীঘির পশ্চিমে খাসিরচক গ্রামে ছিল শিতালং শাহর স্থায়ী নিবাস। গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ি মাদ্রাসায় পড়ার সময় তাঁর মনে ফকিরি বীজ বপন হয়েছিলো বলে বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানাগেছে। এরপর তা প্রস্ফুটিত হয় কাছাড় জেলার সীমান্তের ভূবন পাহাড়ে দীর্ঘ একযুগ সাধনার মাধ্যমে। তাঁর সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী রয়েছে। বাঘের পিঠে চড়ে মাকে দেখতে আসার ঘটনাটি লোকমুখে শোনা যায়।
শিতালং শাহ’র সাহিত্য সমগ্রের একটি বড় অংশ হচ্ছে কবিতা ও গান। এগুলি মূলত আধ্যাত্বিক কবিতা ও ‘ভাবগান’। বাংলা, আরবী, ফারসি, সংস্কৃত ও আঞ্চলিক শব্দের অনুপম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় তাঁর রচনায়। এসব কবিতা ও ভাবসঙ্গীত শুধু চিত্তের খোড়াকই নয় ধর্ম বিশ্বাস ও জীবনবোধের এক অফুরন্ত ভান্ডারও। লেখকের হাতের লেখা একটি খাতা ছিল যেটির বেশির ভাগ পাতা তাঁর ভক্তরা তাবিজ হিসেবে ব্যবহারের জন্য চুরি করে নেন বলে মতিন উদ্দিন আহমদ তার এক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তবে শিতালং শাহ’র হাতের লেখা কিছু কবিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে মাইক্রোফিল্ম করে রাখা ছিল। এখন তা সংরক্ষিত আছে কিনা তা জানা যায়নি। কবির প্রায় সব রচনাই সিলেটী নাগরীতে লেখা একটি বইয়ে একত্রে আছে বলে শিতালং শাহর চতুর্থ অধ:স্তন পুরুষ মাওলানা আব্দুস সালাম জানিয়েছেন। যেটি এখন বাংলা একাডেমীতে জমা আছে। এর একটি বাংলা অনুবাদ বারঠাকুরি শিতালংগীয়া মাদ্রাসায় সংরক্ষিত আছে। আধ্যাত্বিক গানের অমর এই ¯্রষ্টা সুফি ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
তার অসংখ্য আধ্যাত্বিক গানের মধ্যে অমর রাগ ‘ওবা দয়াল আল্লাজি / পুল ছিরাত সংকটে মোরে তরাই নিবায়নি / আল্লাজি-করিয়াছি কত গোনা তোমারে বেরাজী / শয়তানের ধোঁকায় পইড়া দায়ে ঠেকছি আজি’। ‘রে নাগর রসিয়া / নদীয়ার কুলে বসিয়া / ডাকি বন্ধু কলংকিনী হইয়া’।
প্রয়াত মানবাধিকারকর্মী ফারুক আহমদ লস্কর তাঁর একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ‘বাংলা আসামের প্রধান সাধক শিতালং শাহ’র গান বাংলা আসামের রেডিও টেলিভিশনে এখনো প্রচার হয়’।
জকিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল খায়ের চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, শাহ শিতালং এর লেখা নকল করে কেউ কেউ গীতিকার হিসেবে পরিচিতি নিচ্ছেন। ১৯৯০ সালে বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিমের সাথে দেখা করতে গেলে আব্দুল করিম শিতালং শাহকে বাউলদের গুরু হিসেবে উল্লেখ করেন। শিতালং শাহ হিন্দু সাধন পদ্ধতিতেও ডুব দিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে রাধিকা এবং আল্লাহকে কৃষ্ণরূপে কল্পনা করেছেন তাঁর অনেক লেখায়। শরীয়ত-মারিফতের জ্ঞান লাভ করে এবাদত-বন্দেগী, সাধন-ভজন, জপ-তপ, ধ্যান আর আরাধনার মাধ্যমে নিজেকে আধ্যাত্মিকতার জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভাষা সৈনিক মতিন উদদীন আহমদ, গবেষক নন্দলাল শর্মা, অনুসন্ধিৎসু লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, কথাশিল্পী আব্দুল হামিদ মানিক, প্রয়াত শিক্ষাবিদ আব্দুর রহিম জকি শিতালং শাহের জন্ম, শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, আধ্যাত্বিকতা, কর্ম, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, ধর্ম দর্শণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা ও লেখালেখি করেছেন। ২০০৫ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রফেসর নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত ‘মরমী কবি শিতালং শাহ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
শিতালং শাহর অধ:স্তন পুরুষ মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক জানান, প্রখ্যাত আলেম মোশাহীদ বায়মপুরী (র.) গভীর মনোযোগে শিতালঙ্গীয়া রাগ শুনতেন। আল্লামা ফুলতলী ছাহেবও শিতালংগী রাগের ভক্ত ছিলেন বলে তাঁর পুত্র শিহাব উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন। আগে আগে ঘরে ঘরে শিতালংগি রাগের আসর বসতো। মানুষের মুখে মুখে ছিল আধ্যাত্মরসের শিতালংগী রাগের আবেগঘন সুর ও বাণী। অমর্ত্যলোকীয় অনুভবের জগৎ এবং পবিত্র আনন্দের অনুষঙ্গ ছিল শিতালঙ্গীয়া রাগ।
Leave a Reply