আল হাছিব তাপাদার, জকিগঞ্জ টুডে:: ‘আমরা বুড়ো দুই বোনকে দেখার কেউ নাই, আমরারে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেবেন। একখানা ঘরের ব্যবস্থা করি দিলে আল্লাহ তোমারে ভাল করবেন।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে অঝোরে কাঁদলেন জকিগঞ্জের সত্তোরোর্ধ বিধবা হোসনা বেগম ও ছালেহা বেগম।
তাদের এই আবেগমাখা আর্তনাদ হয়তো কারো কাছে পৌঁছাবে না বলে মনে করেন তারা।
নিঃসন্তান বিধবা দু’বোন হোসনা ও ছালেহার থাকার মতো একটু জমি থাকলেও মাথা গোঁজার মতো একটি ভালো ঘর নেই। বাস করেন ঝুঁপড়িঘরে। দুজনের স্বামী মারা যাবার পর প্রথম দিকে বাসা বাড়িতে কাজ করে পেট চালালেও এখন বয়সের ভারে ও বার্ধক্য জনিত নানা রোগে নুয়ে পড়া এই বৃদ্ধারা ভিক্ষা করেই দিনাতিপাত করেন। দারিদ্র্যতার সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয় তাদেরকে। কখনো একবেলা খেয়ে আবার কখনো না খেয়েই। জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছে অসহায় এই দু’বোন। তবুও তাদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি ঘরসহ অনান্য সুযোগ-সুবিধা।
হোসনা ও ছালেহারা মনে করেন, টাকা ছাড়া ঘর পাওয়া যায় না। তাই টাকার অভাবে ঘরও পাচ্ছেন না। বর্তমানে তারা দু’বোন একটি জরাজীর্ণ বিদ্যুৎহীন ঝুঁপড়িঘরে ঝুঁকি নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিধবা ভাতা পেলেও সরকারের অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে তারা।
জকিগঞ্জ পৌর এলাকার ৪নং ওয়ার্ডের গন্ধদত্ত গ্রামে হোসনা ও ছালেহার বসবাস। রাস্তা ছাড়াই জঙ্গলের মত একটি জায়গায় ভাঙ্গা টিনের ছাউনি ও বেড়া দিয়ে বানানো ছোট একটি ঘরে থাকেন তারা। বৃষ্টি এলে ঘরে পানি পড়ে ভিজে যায় সবকিছু। নির্ঘুম রাত কাটে তাদের।
জঙ্গলের মত জায়গায় বসবাস হওয়ার কারণে সেখানে মশা মাছির উপদ্রব মারাত্মক। একই কোটায় থাকা খাওয়া, খোলা স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ হাস, মোরগ ও ছাগলের বসবাস। নেই বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা।
জানা গেছে, হোসনার বিয়ে হয়েছিলো বিয়ানীবাজারের নবাব আলীর সাথে ও ছালেহার বিয়ে হয়েছিলো কুমিল্লার একজন পুলিশ কর্মকর্তার (কোর্ট পুলিশের সিএসআই) সাথে। বিয়ের কয়েক বছর পরই একেএকে দু’বোনের স্বামী মারা যান। এরপর তাদের জীবনে নেমে আসে দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্চনা, বঞ্চনা। স্বামীর বাড়ি থেকে এসে বাবার বাড়ি পৌর এলাকার ৬নং ওয়ার্ড কেছরী গ্রামে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু বাবার বসত ভিটায়ও থাকতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গন্ধদত্ত গ্রামে ১৮ শতক জায়গা কিনে বসতি গড়ে তুলেন। প্রথম দিকে বাসা বাড়িতে কাজ করে দিনযাপন করলেও এখন নেই শরীরে শক্তি। বার্ধক্য ঘিরে ধরেছে তাদেরকে। নানা রোগেও বাসা বেধেঁছে দেহে। শরীরের চামড়ায় কুঁচ ধরে গেছে। পড়ে গেছে মাথার চুল। ভিক্ষা করে যা পান তাই দিয়ে পেট চালান। তাও বার্ধক্যর কারণে নিয়মিত ভিক্ষা করতে পারেন না। প্রতি মাসে ৫/৬ দিন ভিক্ষা করে যা জোটে তা দিয়েই সংসার চালান। খাবার শেষ হলে থলি হাতে নিয়ে আবার বের হন ভিক্ষায়। এভাবেই দিনকাল যাচ্ছে অসহায় এই দু’বোনের।
ঈদের আগের দিন মঙ্গলবার হোসনা বেগমকে লাঠির উপর ভর দিয়ে থলি হাতে নিয়ে জকিগঞ্জ শহরে ভিক্ষা করতে দেখেন সিলেটভিউ’র প্রতিনিধি আল হাছিব তাপাদার। তখনও অসুস্থ ছিলেন হোসনা বেগম। বিষয়টি আল হাছিব তাপাদার তাৎক্ষণিক উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব হোম দাসকে অবগত করলে তিনি সাথে সাথে ঐ বৃদ্ধাকে নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু খাদ্য সামগ্রী কিনে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
কোরবানির ঈদের দিনও মাংসের ব্যবস্থা করে বাড়িতে পাঠান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব হোম দাসের মানবিক কর্মকান্ডে তিনি ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন। বিধবা দু’বোনের অসহায়ত্বের খবর শুনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ফারুক আহমদও খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে হোসনা ও ছালেহা আক্ষেপ করে বলেন, বিনা চিকিৎসায় খেয়ে না খেয়ে ঝুপড়িঘরে দিন কাটছে। এখন জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি। শুনেছি শেখের বেটি হাসিনা ঘর দিচ্ছে। আমাদেরকে যদি দয়া করে একটা ঘর দেয় তাহলে জীবনের শেষ কয়টা দিন একটু আরাম করে ঘুমাতে পারবো। বিধবা ভাতা ছাড়া সরকারের অন্য কোন মানবিক সহায়তা থেকেও বঞ্চিত রয়েছি।
তারা দু’বোনের আশা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী, মুজিববর্ষে হয়তো সরকারের পক্ষ থেকে একটি ঘর পাবেন। যে ঘরে একটু শান্তিতে বসবাস করে মরতে পারবেন। কিন্তু এমন আশা বাস্তব হওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছে তাদের। ঝড় বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে খেয়ে না খেয়ে ঝুপড়িতে মানবেতর জীবনযাপনই যেন দু’বোনের নিয়তি!
তাছাড়াও তারা সমাজের বিত্তবান মানুষের কাছে একটি ঘর চেয়ে আকুল আবেদন করে তারা বলেন, কোন দানশীল ব্যক্তি যদি আমাদেরকে একটি ঘর দিতেন তাহলে মরার আগ পর্যন্ত শান্তিতে থাকতাম। জীবনের শেষ সময়ে এসেও সুখের দেখা মিলেনি। বৃষ্টির দিনে খুবই কষ্টে সময় কাটে। মেয়ে হওয়ার যন্ত্রনাটা এখনো সহ্য করতে হচ্ছে বলে অঝোরে কাঁদেন দু’বোন।
প্রতিবেশি জুবের আহমদ জানান, ‘নিঃসন্তান বিধবা হোসনা ও ছালেহা একেবারে অসহায়। ঝুপড়ির মাঝে ভাঙা টিনের ঘরেই বাস করে তারা দুজন। একটু জোরে বাতাস আসলে ঘর ভেঙে যাবার উপক্রম হয়। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। সরকারে কাছে জোর দাবি করছি-তাদেরকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিন। প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে গৃহ দেওয়ার প্রকল্প থেকে তাদের ভূমির উপর একটি ঘর তৈরী করে দিলে তারা জীবনের শেষ সময়ে সুখে থেকে মরতে পারতো।’
জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আব্দুল আহাদ বলেন, হোসনা ও রোসনা বেগমরা পরিবারের কাহিনী শুনে মনে হয়েছে প্রকৃতপক্ষেই তারা অসহায়। সরকারীভাবে একটি ঘর পেলে তারা সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। আমি চেষ্টা করবো তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করতে।
এ প্রসঙ্গে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পল্লব হোম দাস বলেন, অসহায় বৃদ্ধা ভিক্ষা করছেন এমন খবর শুনে সাথে সাথেই আমি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে তাদেরকে সহযোগীতা করেছি। অসহায় হোসনা বেগমকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জমিসহ ঘর দেবার কথা বলেছিলাম কিন্তু তিনি জমিসহ ঘরে উঠতে রাজী হননি। হোসনা বেগম চাচ্ছেন তার নিজস্ব জমিতে ঘর তৈরী করে বসবাস করতে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমী আক্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, এই দুই বিধবা মহিলার ব্যাপারে জানা ছিলো না। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগীতা করা হবে। নিজস্ব জায়গার উপর ঘর নির্মাণের প্রকল্পটি এখন বন্ধ রয়েছে। এরপরও তাদের নিজস্ব জায়গা থাকলে সেই জায়গায় একটি সরকারি ঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করবো।
Leave a Reply