জকিগঞ্জ টুডে ডেস্ক:: প্রাক্তন ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী এবং পুলিশের সাবেক ডিআইজি, জকিগঞ্জ থানার কৃতিসন্তান এম এ হকের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার।
এ উপলক্ষে এম এ হক স্মৃতি সংসদ স্মরণ সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে জুম্মার নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদে দোয়া মাহফিল ও শিরনী বিতরণ, বেলা ৩ টায় জকিগঞ্জ এম এ হক চত্তরে স্মরণ সভা।
স্মরণ সভাকে সফল করতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে এম এ হক স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে অতিথিবৃন্দকে স্বাগত জানিয়ে মিছিলও করা হয়েছে। মিছিলে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এম এ হক স্মৃতি সংসদের সভাপতি আমাল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মোছলেহ উদ্দিন সুহেল, উপজেলা যুবলীগের সিনিয়র সদস্য ফয়েজ আহমদ, উপজেলা শ্রমিকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মুকিত মেম্বার, যুবলীগ নেতা নাজু আহমদসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
স্মরণ সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মরহুম এম এ হকের কন্যা বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা ও সংগীত ব্যক্তিত্ব রেহানা আশিকুর রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাশেক রহমান প্রমূখ। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন।
এম এ হক স্মৃতি সংসদের সভাপতি আমাল আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মোছলেহ উদ্দিন সুহেল জানিয়েছেন, প্রধান অতিথি সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ এন আশিকুর রহমান, বিশেষ অতিথি রেহানা আশিকুর রহমান ও রাশেক রহমান সকাল ১১ টায় জকিগঞ্জে পৌছবেন। এরপর তাঁরা দুপুর ১২ টা ১০ মিনিটে জকিগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নবনির্মিত ভবন পরিদর্শন করবেন। ১২টা ৪৫ মিনিটে কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করে দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটে কুশিয়ারা নদীর ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করবেন। বেলা সাড়ে ৩ টায় জকিগঞ্জ বাজারের এম এ হক চত্তরে স্মরণ সভায় উপস্থিত হবেন। রাত ৮টায় তাঁরা সিলেটের উদ্দেশ্যে জকিগঞ্জ ত্যাগ করবেন বলে তারা জানান।
জকিগঞ্জের রতœগর্ভা সন্তান জকিগঞ্জ-কানাইঘাট তথা সিলেটবাসীর এক সময়ের জনপ্রিয় নেতা এম এ হক (বাঘা হক) ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। পরে তাঁকে রাজধানীর বনানী গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। মরহুম মোহাম্মদ আব্দুল হক (এম এ হক) ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারী জকিগঞ্জ উপজেলার কাজলসার ইউনিয়নের কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সাহেবজান আলী ও মাতা সকিনা খাতুনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এম এ হক। কামালপুরের পল্লী অঞ্চল থেকে বেড়ে উঠা এম এ হক ছিলেন একাধারে একজন সফল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, লেখক, দারিদ্র্য বিমোচনের প্রবক্তা ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসননীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে হাতে গোণা কিছু মানুষের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এম এ হক।
কামালপুর পাঠশালায় এম এ হকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। এরপর তিনি ১৯৩৮ সালে সিলেট হাইস্কুলে থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪০ সালে এমসি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অর্নাস-ইংলিশ) ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্র জীবনে তিনি আসাম মুসলিম স্টুডেন্ট ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ছিলেন (১৯৪০-৪২ সাল)। পড়া-লেখা শেষ করে আসাম সরকারের পুলিশ বিভাগে ডিএসপি পদে এম.এ হক যোগদান করে কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ বিভাগকালীন সময়ে তিনি কমিরগঞ্জ মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (ডিএসপি) ছিলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি সিলেটে এডিশনাল এসপি হিসেবে যোগ দেন। এডিশনাল এসপি চট্টগ্রাম (১৯৪৯), এসপি নোয়াখালী (১৯৫০-৫১), এসপি রংপুর (১৯৫২-৫৫), এসপি ময়মনসিংহ (১৯৫৫-৫৬), এসপি ঢাকা (১৯৫৭-৫৯)। এরপর ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে এডিশন্যাল ইন্সপেক্টর অব পুলিশ (১৯৬০), ডি আইজি অব পুলিশ অব (১৯৬১) ডি আইজি অব পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চ (১৯৬২-৬৪), চেয়ারম্যান সড়ক পরিহবহন সংস্থা (১৯৬৪-৬৯)। চাকুরি জীবনে এম এ হক বিভিন্ন দেশে পেশাগত বিশেষ ট্রেনিং গ্রহণ করেছেন। যেমন বৃটিশ ইন্সটিটিউট অব পুলিশ-মালয়েশিয়া (১৯৫৫), ইন্টারপোল-প্যারিস (১৯৬৪), স্কুটল্যান্ড ইয়ার্ড-লন্ডন (১৯৬৪), ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমী ওয়াশিংটন ডিসি (১৯৬৪), পুলিশ এডমিনিস্ট্রেশন, হনলুলু (১৯৬৪), ফিলিপিনস আর্মি ইন্টেশিজেন্স (১৯৬৪) ও টোকিও পুলিশ (১৯৬৫)। সৎ সাহসী ও কর্মনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিলো ব্যাপক।
কর্মজীবন যখন যেখানে গেছেন পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে বহুমুখী আবদান রেখেছেন তিনি। নোয়াখালীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রাইমারী স্কুল, মসজিদ ও মক্তব। নোয়াখালী পুলিশ লাইন পার্ক, ফেনী পুলিশ ক্লাব। তিনি নিজে যেমন ছিলেন নিবেদিত শিক্ষানুরাগী, ঠিক তেমন করে অসংখ্য মানুষ তৈরি করেছেন প্রতিনিয়ত। যে কারনে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ায় তাঁর ছিলো বিশেষ অবদান। তিনি রংপুর প্রতিষ্ঠা করেন প্রাইমারী স্কুল, পুলিশ লাইব্রেরী, ডেইরী ফার্ম, টাউন হল। ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠা করেন প্রাইমারী স্কুল ও পুলিশ কেন্টিন। ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন পুলিশ ক্লাব (১৯৫৭), রাজারবাগ পুলিশ ক্লাব (১৯৫৮), পুলিশ কো অপারেটিভ সোসাইটি (১৯৬০), সাপ্তাহিক ইংরেজী সংবাদ ম্যাগাজিন দ্য ডিটেকটিভ (১৯৬০)। পুলিশ প্রশাসেনের নিজস্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পলওয়েল প্রিন্টিং প্রেস (১৯৬২), পলওয়েল শপিং সেন্টার (১৯৬৩), জোনাকী সিনেমা হল (১৯৬২) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম প্রাইভেট হাসপাতাল ‘আরোগ্য’। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠা করেন দিলকুশা লায়ন্স ক্লাব (১৯৭৪)। ১৯৭৪ সাল থেকে দীর্ঘ দিন তিনি প্রবাসীর ডাক নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন। এম এ হক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর-পুলিশ কো-অপারেটিভ সোসাইটি (১৯৬০-৭০), সভাপতি-জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকা (১৯৬১-৭৭), সহ সভাপতি- ডায়েবেটিক সোসাইটি (১৯৬২/৮৬)। ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনের এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮৪-৮৫ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জকিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও এম এ হকের ব্যাপক অবদান রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারী গঙ্গাজল গ্রামের রেডিও ইঞ্জিনিয়ার কুতুব উদ্দিনকে প্রধান শিক্ষক করে বেসরকারী ভাবে যাত্রা শুরু হয় জকিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের। এ বছরই পুলিশ কর্মকর্তা এম এ হকের প্রচেষ্টায় তৎকালীন ভিপিআই ড. কুদরত-ই-খুদা জকিগঞ্জ এসে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে যান। অল্প দিনের মধ্যে এ বিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। জকিগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠাতে তাঁর অবদান ছিলো বেশি। ১৯৮৪ সালে এম এ হক জকিগঞ্জের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ। পূর্ণ সরকারী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর অনুদানে কলেজ পরিচালিত হয়।
১৯৭৮ সালে ভারত সরকার জকিগঞ্জ বাজারের পূর্ব দিক বরাবর কুশিয়ারা নদীতে গ্রোয়েন নিমার্ণ শুরু করে। তখন এম এ হক ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেন। জকিগঞ্জবাসীকে সাথে নিয়ে তিনি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। এম এ হকের সাহসী ভূমিকার মুখে তৎকালীন জিয়াউর রহমান সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ভারত সরকার গ্রোয়েন নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করে।
প্রবীণ ব্যক্তিগণ জানান, ১০ কোটি রুপি ব্যয়ে এই গ্রোয়েন বাস্তবায়িত হলে জকিগঞ্জ বাজার সহ পার্শবর্তী এলাকা কুশিয়ারা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যেতো। এ ছাড়া এম এ হকের প্রচেষ্টায় জকিগঞ্জ মহকুমা শিক্ষা অফিস, মহকুমা আনসার অফিস, পানি উন্নয়নে দিক নির্দেশনামূলক অনেক কাজ হয়। ভূমি মন্ত্রী থাকাকালিন সময়ে তিনি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক কাজ করেছেন।
রাজনৈতিক জীবনে এম এ হক জনদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (১৯৮৫-৮৬) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তনের জনক। মরহুম এম এ হক গোটা সিলেটের মানুষের কথা ভাবতেন সবসময়।
Leave a Reply